সরোজিনী নাইডু: বিক্রমপুরের যে কন্যার স্মরণে পালন করে জাতীয় নারী দিবস
আবুল কাশেম, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি :
২০ নভেম্বর, ২০২৫, 7:20 PM
সরোজিনী নাইডু: বিক্রমপুরের যে কন্যার স্মরণে পালন করে জাতীয় নারী দিবস
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইতিহাসে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামের নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে এক মহীয়সী নারীর সুবাদে-তিনি সরোজিনী নাইডু।
নারীদের জন্য তাঁর অবদান এবং নারী হিসেবে তাঁর কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নারী দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে।
বিক্রমপুরের এই কৃতি সন্তান ছিলেন একাধারে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি এবং স্বাধীন ভারতে প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হওয়ার বিরল সম্মান অর্জনকারী। তাঁর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী অবদান আজও দেশপ্রেম ও নারীমুক্তির পথে প্রেরণা যোগায়।
১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের হায়দ্রাবাদে জন্ম হলেও, তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। পারিবারিক সূত্রে শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী।
মেধাবী ছাত্রী থেকে ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’
অত্যন্ত মেধাবী এই নারী মাত্র বারো বছর বয়সে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় গোটা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডে লন্ডনের কিংস কলেজ ও কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষায় সাবলীল ছিলেন। তাঁর বাগ্মিতা ছিল প্রখর, এবং তিনি চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারতেন। ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চার জন্য তিনি ‘ভারতীয় কোকিলা’ বা ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: The Golden Threshold, The Bird of Time ও The Broken Wing।
১৭ বছর বয়সে চিকিৎসক ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন এবং ১৯ বছর বয়সে তাঁকে বিবাহ করেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ হয়েও অব্রাহ্মণকে বিয়ে করার মতো অসবর্ণ বিবাহ (কোনো এক বর্ণের ব্যক্তির অন্য বর্ণের ব্যক্তিকে বিবাহ করা ঐতিহাসিকভাবে অসবর্ণ বিবাহ বলে গণ্য) ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ, যা তাঁর প্রগতিশীল মননকে তুলে ধরে।
ডান্ডি পদযাত্রা থেকে কংগ্রেসের সভাপতি
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্র ধরে সরোজিনী নাইডু যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২০ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই সক্রিয় হন। ব্রিটিশ বিরোধী আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একজন সক্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি ঐতিহাসিক ডান্ডি পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।
যে সময়ে নারীদের জীবন ছিল ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেই সময়েই ১৯২৫ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে, কিন্তু কখনোই তিনি পিছপা হননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পর তিনি উত্তরপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন, প্রথম ভারতীয় মহিলা রাজ্যপাল হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেন তিনি।
কবি সরোজিনী নাইডু
ইংল্যান্ডের বিদ্বান সমাজে কবিতার জন্য সরোজিনী সমাদৃত হন। সে সময়ে তিনি বিখ্যাত সমালোচক Edmund Gosse-এর সংস্পর্শে আসেন, যিনি তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করে বলেছিলেন- Skilful in form, correct in grammar and blameless in sentiment but western in feeling and imaginary, তিনি সরোজিনীকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে কাব্যচর্চা করার পরামর্শ দেন।
তাঁর উপদেশ মতো তিনি হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবদের হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি পটভূমিকে কেন্দ্র করে কাব্যচর্চা করেন।
তাঁর প্রথম বই ‘The Golden Threshold’ ১৯০৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হলে বিপুল সাড়া পড়ে এবং খুবই ভালো কাটতি হয়। তাঁর কবিতার অন্য বইগুলি The Feather of the Dawn, Bird of time, The Sceptered Flute and The Broken wing পাঠক-বোদ্ধা দ্বারা সমাদৃত হয়। The Bird of time ১৯১২ সালে এবং The Broken wing ১৯১৭ সালে হ্যানিম্যান কর্তৃক ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়।
তাঁর কিছু কবিতা ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর তিনটি কবিতা The Souls prayer, In Salutation to the Eternal Peace এবং To the Buddha seated on a Lotus, The Oxford book of English Mystical Verse-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর রচিত Palanquin bearers, Wandering sign, Village song. Cradle song কবিতা যথাক্রমে পালকি বেহারার গান, চারণ, পল্লীগীতি, রামধনু ও ঘুমপাড়ানীর গান নামে বাংলায় অনুদিত হয়। এর কোনো কোনোটির অনুবাদ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত।
শ্রদ্ধায়-স্মরণে অমলিন সরোজিনী নাইডু
১৯৪৯ সালে জন্মদিনের প্রাক্কালে সরোজিনী নাইডু রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়িতে দিল্লি যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গাড়ি হতে নামার সময় মাথায় বেশ আঘাত পান। মাথাব্যথা নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লক্ষ্ণৌ ফিরে আসেন। এদিকে কমলা নেহরু হাসপাতালে রাজা গোপালাচারীর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষার্ধে আসার প্রোগ্রাম ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রথম সফরে তিনি অসুস্থ থাকায় প্রথা অনুযায়ী তাকে সম্মান দেখাতে পারবেন না, এটা তাঁর কাছে খুবই খারাপ বোধ হচ্ছিল। ঠিক হলো পদ্মজা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এলাহাবাদে গিয়ে সকল ব্যবস্থা করবেন। লীলামনি দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিরত, ছেলে ও ডা. নাইডু হায়দ্রাবাদে, ফলে পরিবারে কোনো সদস্যই তাঁর অসুস্থতার সময় কাছে ছিলেন না।
শ্বাসকষ্ট হওয়ায় ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে অক্সিজেন দেয়া হলো। ২০ ফেব্রুয়ারি ডা. বিধান চন্দ্র রায় লক্ষ্ণৌ এসে তাঁর চিকিৎসার ভার নিলেন। তিনি একটু সুস্থ বোধ করলেন। ডা. মিশ্র ও ডা. ভাটিয়া ২৫ তারিখ তাঁকে পুনরায় পরীক্ষা করলেন এবং পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বললেন। ১ মার্চ রাত্র ৯.৩০ মিনিটে তাঁর শরীরে রক্ত দেয়া হলো। তিনি সামান্য ঘুমালেন, রাত্র ১০.৪০ মিনিট তিনি আবার জেগে উঠলেন এবং নার্সকে গান শুনাতে বললেন। গান শেষ হলে তিনি নার্সকে বললেন আমি চাই না আর কেউ আমার সাথে কথা বলুক- এই ছিল তাঁর শেষ কথা। রাত্র ২.৪৫ মিনিটে তিনি আবার জেগে উঠলেন। একটু কাশি হচ্ছিল এবং রাত্র ৩.৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ টেলিফোনে গভর্নর জেনারেল রাজা গোপালাচারী, প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু, পদ্মজা নাইডু ও কৈলাশনাথ কাটজুকে জানানো হলো। তারা সবাই এলাহাবাদে কমলা নেহরু হাসপাতালে বেগম আজাদ ওয়ার্ড উদ্বোধন উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর স্বামী ড. নাইডু ও কন্যা লীলামনিকেও টেলিফোনে জানানো হলো। শোকার্ত নেতৃবৃন্দ লক্ষ্ণৌ চলে আসেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দুপুরে মরদেহ গভর্নমেন্ট হাউসের উত্তর দিকের বারান্দায় নিয়ে রাখেন এবং গভর্নমেন্ট হাউসের গেট খুলে দেন। সর্বশ্রেণীর লোক তাদের প্রিয় গভর্নরকে দেখার জন্য সমবেত হয়ে তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। দোকানপাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ভারতের সর্বত্র বন্ধ হয়ে যায়। পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতুবি করা হয়। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। গোটা ভারতবর্ষ শোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়।
মরদেহ ইন্ডিয়ার ত্রিবর্ণীয় পতাকা দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়। ফুলে ফুলে কফিন ভরে যায়। ধর্মীয় প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক সঙ্গীত গীত হয়। মরদেহটি পণ্ডিত নেহরু, পণ্ডিত পন্থ, পদ্মজা নাইডু ও ডা. জয়সূর্য ধরাধরি করে একটি সামরিক শকটে ওঠালেন। শোকবিধুর পরিবেশে নিকট আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, লেডি মাউন্টব্যাটেন, লেডি প্যামেলা মাউন্টব্যাটেন, গভর্নর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী, ইউপির মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, মৌলানা আজাদ ও রফি আহম্মদ কিদওয়াই প্রমুখ শোক মিছিলে অংশ নেন। পদাতিক, বৈমানিক পুলিশ ও অশ্বারোহী পুলিশের দল মিছিলে সহ-যাত্রী হন। প্রায় আড়াই মাইল পথ পুলিশ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং দুই পাশে শোকবিহ্বল ক্রন্দনরত জনতা, মহিলা ও শিশু কফিনে তাদের শেষ শ্রদ্ধার্ঘ পুষ্প বর্ষণ করতে থাকে, শব মিছিলের অগ্রভা
সরোজিনী নাইডুর সমাধি গোমতী নদীর তীরে সুরম্য নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর ২ মার্চ রাজ্যের পক্ষ থেকে বেদীতে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ও এ প্রদেশে নতুন গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এখানেও এসে প্রথমেই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর জন্ম তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারির ভারতে নারী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তাঁর স্মরণে ডাক বিভাগ টিকেট প্রকাশ করেছে।
সরোজিনীর মৃত্যুতে The Statesman পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখায় হয় যে, মৃত্যু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকজন যশস্বী নেতার জীবন কেড়ে নিল। বাংলার প্রভাবশালী সু-কন্যা মিসেস সরোজিনী নাইডু প্রায় ত্রিশ বছর যাবতীয় সংগ্রামে, মেয়েদের সামাজিক ও আইনানুগ অধিকারের সংস্কারে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ব্রিটেন ও আমেরিকায় বিরাট সম্মান অর্জন করেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন স্বচ্ছ, অকপট, অপ্রাসাদিক এবং উদার। গভর্নরের হিসেবে তিনি ছিলেন এক চমৎকার আদর্শ। তাঁর মৃত্যু সবাইকে ব্যথিত করেছে।
ভারতের সব পত্রিকাতেই এরূপ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয় একজন মানুষের জীবনে তাঁর মতো অগ্নি দেখি নাই। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের ফেলো ছিলেন। তিনি বোম্বে মিউনিসিপ্যালিটির ১৯২৪-১৯২৯ সাল পর্যন্ত সদস্য ছিলেন। ভারতে সকল বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। তিনি কবি, বক্তা, মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ হস্ত, পণ্ডিত দূত, হিন্দু-মুসলমান মিলনের সূত্রধরী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার ও প্রদেশের প্রথম মহিলা সভাপতি, স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা গভর্নর। তিনি হায়দ্রাবাদে বন্দে মাতরম্ সঙ্গীত আবৃত্তিশিল্প সংরক্ষণ করেন এবং ‘কায়সারে হিন্দ স্বর্ণ পদক’ পান যা ১৯১৯ সালে জালিয়ানাওয়ালার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ও আবুল কালাম আজাদ সে স্বর্ণপদক প্রত্যার্পণ করেন, ১৯২২ সালে কংগ্রেস ও স্বরাজ দলের মধ্যে কাঁটাদলে প্রবেশ নিয়ে মতভেদ হলে তিনি মহাত্মাজীর মতের অবস্থানে দৃঢ় অবস্থান নেন।
তিনি ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৩০ সালে ২৯ মে লবণ সত্যাগ্রহ মার্চ পরিচালনার অপরাধে প্রথম কারারুদ্ধ হন এবং গান্ধী আরউইন সন্ধির ফলে ১৯৩১ সালের জানুয়ারি ১৯৩১ সালে মুক্তি পান। দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক হতে ফিরে এসে আমেদাবাদে আনাগোনায় নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে দ্বিতীয় বার কারারুদ্ধ করেন জানুয়ারি ১৯৩২ সালে। মুক্তির পর ভারত সরকারের প্রতিনিধির হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। সর্বশেষ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪২ সালে কারারুদ্ধ করেন এবং আবার প্রাধান্যে থাকার কারণে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ থাকেন। তিনি ব্যাপকভাবে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। তাঁর প্রতিবাদীত্ব, ক্ষিপ্রমধুরতায় সারা ভারতও একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শ্রীনিবাস শাস্ত্রী।
তাঁর একজন জীবনী লেখক তারা আলী বেগ বলেছেন: The life of Sarojini Naidu was a work of art, in death she was alone, but in life she belonged wholly to the world and in her life she fulfilled the standard laid down by Tulsidas. : “When you come into the world you cry and the whole world laughs; so live that when thou departest, thou mayest laugh while the world will be in tears.” (সরোজিনীর জীবন ছিল শিল্পকলার মতো। মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ একা কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন সকলের জন্য নিজের জীবনে তিনি সম্পূর্ণ করেছেন তুলসী দাস যে সাধক জীবনের কথা বলেছেন— তুমি যখন পৃথিবীতে এসেছ তখন তুমি কাঁদলে আর সকলে হাসল; তুমি এভাবেই বাঁচ যাতে যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তখন তুমি হাসবে। আর সারা পৃথিবীর লোক কাঁদবে।)
সরোজিনী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছেন: “She lifted politics to a higher artistic sphere. Whatever she touched she infused with something of her fire…. She represented herself a rich culture into which flowed various currents which have made Indian culture as great as it is.” (তিনি রাজনীতিকে উচ্চতর শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি যা কিছু স্পর্শ করতেন তাতেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির ছাপ পড়েছে। তিনি অত্যন্ত উন্মাদনাময় কৃষ্টির ধারক-বাহক ছিলেন এবং ভারতের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে তিনি উচ্চতরে উন্নীত করেছেন)। সরোজিনীর মৃত্যুর পর ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন: She did that amazing thing. She infused artistry and poetry into our national struggle… She stood more than any person in India for the unity of India in all its phase’s…… She bream the ideal ambassador and the ideal link between the East and the West and between the various parts and groups of India. (তিনি চমকপ্রদ ব্যাপার করেছেন, শিল্প ও কবিতা আমাদের জাতীয় সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট করেছেন। তিনি ভারতীয়দের একতার জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তিনি পূর্ব, পশ্চিম ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন)।
ভারতের প্রেসিডেন্ট Dr. S. Radha Krishan 1962 সালে সরোজিনী সম্পর্কে বলেছেন- A vivid, warm, vital and intense personality, She learned? radiance and benevolence wherever she was. She was the most outstanding Indian woman of her generation. Sarojini Naidu embod-ied in herself the most valuable elements of India’s composite culture : Hindus, Buddhist, Muslim and British. She is a happy blend of the values of both East & West. (তাঁর চরিত্রে আন্তরিকতা ও স্পষ্টবাদিতার মহা মূল্যবান মিশ্রণ ছিল। তিনি দানশীল ও দীপ্তিমান এবং তাঁর সময়ে তিনি ভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা ছিলেন। তার চরিত্রে ভারতের বিভিন্ন স্থানের ও ধর্মমতের যৌগিক কৃষ্টির যথা- হিন্দু ও বৌদ্ধ, মুসলিম ও ব্রিটিশদের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি পূর্ব-পশ্চিমের গুণাবলির সেতু বন্ধনকারী ছিলেন।)
ভারতের দুই মহান নেতা জওহরলাল নেহরু এবং রাধাকৃষ্ণ অল্প কথায় সরোজিনীর যে মূল্যায়ন করেছেন তা যথার্থ। কবি সরোজিনী নাইডু জাতীয় স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে সরোজিনী নাইডুর কর্ম ও জীবনের ওপর রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়। প্রাবন্ধিক রওশন আরা তাঁর প্রবন্ধে লিখেন, ‘কংগ্রেস নেতা হিসেবে আমাদের ঢাকা নগরীতেও তিনি বেশ কয়েকবার বক্তৃতা করেছেন। ছুটে গেছেন পিতৃভূমি বিক্রমপুরের ব্রাহ্মণগাঁ গ্রামে। বিক্রমপুরের গৌরবগাথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরসহ ভারতবর্ষের যেখানেই গেছেন তিনি সেখানে পেয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনা। বাংলাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক প্রয়াত দেওয়ান আজরফের একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে জানা যায় সরোজিনী সিলেট ও সুনামগঞ্জ সফরকালে জনগণ তাকে কি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য যেন গোটা জেলা ও মহকুমার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড ভিড় পেরিয়ে সভা মঞ্চে পৌছাতে সাহায্য করার জন্য সেদিন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুবক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে দারুণ হিমশিম খেতে হয়েছিল। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সরোজিনী নাইডু।
ঐ অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন- “এখনও আমার সরোজিনী নাইডুর কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসে। কি অলৌকিক মধুর ছিল তাঁর বাচনভঙ্গি। আমি তা গুছিয়ে বলতে পারবে না।” দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো তিনিও মনেপ্রাণে হিন্দু-মুসলমানদের মিলন কামনা করতেন, চাইতেন অনগ্রসর ভারতীয় মুসলমানদের উন্নতি। তৎকালীন ভারতের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। জিন্নাহ সাহেবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। পরবর্তীতে তাঁরা রাজনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল।
বোম্বাই সফরকালে সরোজিনী বরাবরই জিন্নার গাড়িতে উঠতেন। গভীর রাত্র অবধি তারা ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। ফাতেমা জিন্নাহও সে আলোচনায় অংশ নিতেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জিন্নাহ সাহেব হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালান। জিন্নাহ সাহেবের সে অকৃত্রিম আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে সরোজিনী নাইডু তাঁকে Ambassador of Hindu Muslim Unity বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। একদা একজন জীবনীকার লেখক সরোজিনীকে বললেন তিনি কতিপয় বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী লিখেছেন। সরোজিনী তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার তালিকায় জিন্নাহ সাহেবের নাম আছে কি-না? জিন্নাহ সাহেবের নাম নেই শুনে তিনি বিরক্ত হলেন এবং তাকে বললেন, তিনি একজন মহান নেতা তাঁর নাম অবশ্যই থাকা উচিত ছিল।
এই মহীয়সী নারী আজীবন নারীমুক্তি, যুবকল্যাণ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ধারণ করে গেছেন। বিক্রমপুরের এই কন্যা তাঁর কীর্তি ও সাহসের মাধ্যমে সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও সম্মানিত।
উল্লেখ: লেখাটির বেশিরভাগ অংশ নেয়া হয়েছে কবি সরোজিনী নাইডু জাতীয় স্মৃতি পরিষদ কতৃক প্রকাশিত ‘বিক্রমপুর কন্যা সরোজিনী নাইডু বই থেকে।
আবুল কাশেম, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি :
২০ নভেম্বর, ২০২৫, 7:20 PM
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইতিহাসে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামের নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে এক মহীয়সী নারীর সুবাদে-তিনি সরোজিনী নাইডু।
নারীদের জন্য তাঁর অবদান এবং নারী হিসেবে তাঁর কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নারী দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে।
বিক্রমপুরের এই কৃতি সন্তান ছিলেন একাধারে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা, ইংরেজি ভাষার যশস্বী কবি এবং স্বাধীন ভারতে প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হওয়ার বিরল সম্মান অর্জনকারী। তাঁর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী অবদান আজও দেশপ্রেম ও নারীমুক্তির পথে প্রেরণা যোগায়।
১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের হায়দ্রাবাদে জন্ম হলেও, তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের কনকসার গ্রামে। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। পারিবারিক সূত্রে শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী।
মেধাবী ছাত্রী থেকে ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’
অত্যন্ত মেধাবী এই নারী মাত্র বারো বছর বয়সে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় গোটা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডে লন্ডনের কিংস কলেজ ও কেমব্রিজের গার্টন কলেজে পড়াশোনা করেন। সরোজিনী উর্দু, তেলুগু, ফারসি ও বাংলা ভাষায় সাবলীল ছিলেন। তাঁর বাগ্মিতা ছিল প্রখর, এবং তিনি চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারতেন। ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চার জন্য তিনি ‘ভারতীয় কোকিলা’ বা ‘দ্য নাইটেঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: The Golden Threshold, The Bird of Time ও The Broken Wing।
১৭ বছর বয়সে চিকিৎসক ড. মুথ্যালা গোবিন্দরাজুলু নাইডুর প্রেমে পড়েন এবং ১৯ বছর বয়সে তাঁকে বিবাহ করেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ হয়েও অব্রাহ্মণকে বিয়ে করার মতো অসবর্ণ বিবাহ (কোনো এক বর্ণের ব্যক্তির অন্য বর্ণের ব্যক্তিকে বিবাহ করা ঐতিহাসিকভাবে অসবর্ণ বিবাহ বলে গণ্য) ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ, যা তাঁর প্রগতিশীল মননকে তুলে ধরে।
ডান্ডি পদযাত্রা থেকে কংগ্রেসের সভাপতি
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্র ধরে সরোজিনী নাইডু যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও গোপালকৃষ্ণ গোখলের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২০ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সরোজিনী সর্বপ্রথমেই সক্রিয় হন। ব্রিটিশ বিরোধী আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একজন সক্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তিনি ঐতিহাসিক ডান্ডি পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।
যে সময়ে নারীদের জীবন ছিল ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেই সময়েই ১৯২৫ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে, কিন্তু কখনোই তিনি পিছপা হননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পর তিনি উত্তরপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যপাল নিযুক্ত হন, প্রথম ভারতীয় মহিলা রাজ্যপাল হিসেবে ইতিহাস তৈরি করেন তিনি।
কবি সরোজিনী নাইডু
ইংল্যান্ডের বিদ্বান সমাজে কবিতার জন্য সরোজিনী সমাদৃত হন। সে সময়ে তিনি বিখ্যাত সমালোচক Edmund Gosse-এর সংস্পর্শে আসেন, যিনি তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করে বলেছিলেন- Skilful in form, correct in grammar and blameless in sentiment but western in feeling and imaginary, তিনি সরোজিনীকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে কাব্যচর্চা করার পরামর্শ দেন।
তাঁর উপদেশ মতো তিনি হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবদের হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি পটভূমিকে কেন্দ্র করে কাব্যচর্চা করেন।
তাঁর প্রথম বই ‘The Golden Threshold’ ১৯০৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হলে বিপুল সাড়া পড়ে এবং খুবই ভালো কাটতি হয়। তাঁর কবিতার অন্য বইগুলি The Feather of the Dawn, Bird of time, The Sceptered Flute and The Broken wing পাঠক-বোদ্ধা দ্বারা সমাদৃত হয়। The Bird of time ১৯১২ সালে এবং The Broken wing ১৯১৭ সালে হ্যানিম্যান কর্তৃক ইংল্যান্ডে প্রকাশিত হয়।
তাঁর কিছু কবিতা ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। তাঁর তিনটি কবিতা The Souls prayer, In Salutation to the Eternal Peace এবং To the Buddha seated on a Lotus, The Oxford book of English Mystical Verse-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর রচিত Palanquin bearers, Wandering sign, Village song. Cradle song কবিতা যথাক্রমে পালকি বেহারার গান, চারণ, পল্লীগীতি, রামধনু ও ঘুমপাড়ানীর গান নামে বাংলায় অনুদিত হয়। এর কোনো কোনোটির অনুবাদ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত।
শ্রদ্ধায়-স্মরণে অমলিন সরোজিনী নাইডু
১৯৪৯ সালে জন্মদিনের প্রাক্কালে সরোজিনী নাইডু রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়িতে দিল্লি যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গাড়ি হতে নামার সময় মাথায় বেশ আঘাত পান। মাথাব্যথা নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লক্ষ্ণৌ ফিরে আসেন। এদিকে কমলা নেহরু হাসপাতালে রাজা গোপালাচারীর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষার্ধে আসার প্রোগ্রাম ছিল। রাষ্ট্রপতির প্রথম সফরে তিনি অসুস্থ থাকায় প্রথা অনুযায়ী তাকে সম্মান দেখাতে পারবেন না, এটা তাঁর কাছে খুবই খারাপ বোধ হচ্ছিল। ঠিক হলো পদ্মজা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এলাহাবাদে গিয়ে সকল ব্যবস্থা করবেন। লীলামনি দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিরত, ছেলে ও ডা. নাইডু হায়দ্রাবাদে, ফলে পরিবারে কোনো সদস্যই তাঁর অসুস্থতার সময় কাছে ছিলেন না।
শ্বাসকষ্ট হওয়ায় ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে অক্সিজেন দেয়া হলো। ২০ ফেব্রুয়ারি ডা. বিধান চন্দ্র রায় লক্ষ্ণৌ এসে তাঁর চিকিৎসার ভার নিলেন। তিনি একটু সুস্থ বোধ করলেন। ডা. মিশ্র ও ডা. ভাটিয়া ২৫ তারিখ তাঁকে পুনরায় পরীক্ষা করলেন এবং পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বললেন। ১ মার্চ রাত্র ৯.৩০ মিনিটে তাঁর শরীরে রক্ত দেয়া হলো। তিনি সামান্য ঘুমালেন, রাত্র ১০.৪০ মিনিট তিনি আবার জেগে উঠলেন এবং নার্সকে গান শুনাতে বললেন। গান শেষ হলে তিনি নার্সকে বললেন আমি চাই না আর কেউ আমার সাথে কথা বলুক- এই ছিল তাঁর শেষ কথা। রাত্র ২.৪৫ মিনিটে তিনি আবার জেগে উঠলেন। একটু কাশি হচ্ছিল এবং রাত্র ৩.৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ টেলিফোনে গভর্নর জেনারেল রাজা গোপালাচারী, প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু, পদ্মজা নাইডু ও কৈলাশনাথ কাটজুকে জানানো হলো। তারা সবাই এলাহাবাদে কমলা নেহরু হাসপাতালে বেগম আজাদ ওয়ার্ড উদ্বোধন উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর স্বামী ড. নাইডু ও কন্যা লীলামনিকেও টেলিফোনে জানানো হলো। শোকার্ত নেতৃবৃন্দ লক্ষ্ণৌ চলে আসেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দুপুরে মরদেহ গভর্নমেন্ট হাউসের উত্তর দিকের বারান্দায় নিয়ে রাখেন এবং গভর্নমেন্ট হাউসের গেট খুলে দেন। সর্বশ্রেণীর লোক তাদের প্রিয় গভর্নরকে দেখার জন্য সমবেত হয়ে তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। দোকানপাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ভারতের সর্বত্র বন্ধ হয়ে যায়। পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতুবি করা হয়। লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। গোটা ভারতবর্ষ শোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়।
মরদেহ ইন্ডিয়ার ত্রিবর্ণীয় পতাকা দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়। ফুলে ফুলে কফিন ভরে যায়। ধর্মীয় প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক সঙ্গীত গীত হয়। মরদেহটি পণ্ডিত নেহরু, পণ্ডিত পন্থ, পদ্মজা নাইডু ও ডা. জয়সূর্য ধরাধরি করে একটি সামরিক শকটে ওঠালেন। শোকবিধুর পরিবেশে নিকট আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, লেডি মাউন্টব্যাটেন, লেডি প্যামেলা মাউন্টব্যাটেন, গভর্নর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী, ইউপির মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক মন্ত্রী সভার সদস্যবৃন্দ, মৌলানা আজাদ ও রফি আহম্মদ কিদওয়াই প্রমুখ শোক মিছিলে অংশ নেন। পদাতিক, বৈমানিক পুলিশ ও অশ্বারোহী পুলিশের দল মিছিলে সহ-যাত্রী হন। প্রায় আড়াই মাইল পথ পুলিশ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং দুই পাশে শোকবিহ্বল ক্রন্দনরত জনতা, মহিলা ও শিশু কফিনে তাদের শেষ শ্রদ্ধার্ঘ পুষ্প বর্ষণ করতে থাকে, শব মিছিলের অগ্রভা
সরোজিনী নাইডুর সমাধি গোমতী নদীর তীরে সুরম্য নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর ২ মার্চ রাজ্যের পক্ষ থেকে বেদীতে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ও এ প্রদেশে নতুন গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এখানেও এসে প্রথমেই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর জন্ম তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারির ভারতে নারী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। তাঁর স্মরণে ডাক বিভাগ টিকেট প্রকাশ করেছে।
সরোজিনীর মৃত্যুতে The Statesman পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখায় হয় যে, মৃত্যু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকজন যশস্বী নেতার জীবন কেড়ে নিল। বাংলার প্রভাবশালী সু-কন্যা মিসেস সরোজিনী নাইডু প্রায় ত্রিশ বছর যাবতীয় সংগ্রামে, মেয়েদের সামাজিক ও আইনানুগ অধিকারের সংস্কারে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ব্রিটেন ও আমেরিকায় বিরাট সম্মান অর্জন করেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন স্বচ্ছ, অকপট, অপ্রাসাদিক এবং উদার। গভর্নরের হিসেবে তিনি ছিলেন এক চমৎকার আদর্শ। তাঁর মৃত্যু সবাইকে ব্যথিত করেছে।
ভারতের সব পত্রিকাতেই এরূপ মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয় একজন মানুষের জীবনে তাঁর মতো অগ্নি দেখি নাই। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের ফেলো ছিলেন। তিনি বোম্বে মিউনিসিপ্যালিটির ১৯২৪-১৯২৯ সাল পর্যন্ত সদস্য ছিলেন। ভারতে সকল বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। তিনি কবি, বক্তা, মহাত্মা গান্ধীর দক্ষিণ হস্ত, পণ্ডিত দূত, হিন্দু-মুসলমান মিলনের সূত্রধরী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার ও প্রদেশের প্রথম মহিলা সভাপতি, স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা গভর্নর। তিনি হায়দ্রাবাদে বন্দে মাতরম্ সঙ্গীত আবৃত্তিশিল্প সংরক্ষণ করেন এবং ‘কায়সারে হিন্দ স্বর্ণ পদক’ পান যা ১৯১৯ সালে জালিয়ানাওয়ালার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ও আবুল কালাম আজাদ সে স্বর্ণপদক প্রত্যার্পণ করেন, ১৯২২ সালে কংগ্রেস ও স্বরাজ দলের মধ্যে কাঁটাদলে প্রবেশ নিয়ে মতভেদ হলে তিনি মহাত্মাজীর মতের অবস্থানে দৃঢ় অবস্থান নেন।
তিনি ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৩০ সালে ২৯ মে লবণ সত্যাগ্রহ মার্চ পরিচালনার অপরাধে প্রথম কারারুদ্ধ হন এবং গান্ধী আরউইন সন্ধির ফলে ১৯৩১ সালের জানুয়ারি ১৯৩১ সালে মুক্তি পান। দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক হতে ফিরে এসে আমেদাবাদে আনাগোনায় নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে দ্বিতীয় বার কারারুদ্ধ করেন জানুয়ারি ১৯৩২ সালে। মুক্তির পর ভারত সরকারের প্রতিনিধির হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। সর্বশেষ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪২ সালে কারারুদ্ধ করেন এবং আবার প্রাধান্যে থাকার কারণে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ থাকেন। তিনি ব্যাপকভাবে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। তাঁর প্রতিবাদীত্ব, ক্ষিপ্রমধুরতায় সারা ভারতও একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শ্রীনিবাস শাস্ত্রী।
তাঁর একজন জীবনী লেখক তারা আলী বেগ বলেছেন: The life of Sarojini Naidu was a work of art, in death she was alone, but in life she belonged wholly to the world and in her life she fulfilled the standard laid down by Tulsidas. : “When you come into the world you cry and the whole world laughs; so live that when thou departest, thou mayest laugh while the world will be in tears.” (সরোজিনীর জীবন ছিল শিল্পকলার মতো। মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ একা কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন সকলের জন্য নিজের জীবনে তিনি সম্পূর্ণ করেছেন তুলসী দাস যে সাধক জীবনের কথা বলেছেন— তুমি যখন পৃথিবীতে এসেছ তখন তুমি কাঁদলে আর সকলে হাসল; তুমি এভাবেই বাঁচ যাতে যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তখন তুমি হাসবে। আর সারা পৃথিবীর লোক কাঁদবে।)
সরোজিনী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছেন: “She lifted politics to a higher artistic sphere. Whatever she touched she infused with something of her fire…. She represented herself a rich culture into which flowed various currents which have made Indian culture as great as it is.” (তিনি রাজনীতিকে উচ্চতর শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি যা কিছু স্পর্শ করতেন তাতেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির ছাপ পড়েছে। তিনি অত্যন্ত উন্মাদনাময় কৃষ্টির ধারক-বাহক ছিলেন এবং ভারতের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে তিনি উচ্চতরে উন্নীত করেছেন)। সরোজিনীর মৃত্যুর পর ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন: She did that amazing thing. She infused artistry and poetry into our national struggle… She stood more than any person in India for the unity of India in all its phase’s…… She bream the ideal ambassador and the ideal link between the East and the West and between the various parts and groups of India. (তিনি চমকপ্রদ ব্যাপার করেছেন, শিল্প ও কবিতা আমাদের জাতীয় সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট করেছেন। তিনি ভারতীয়দের একতার জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তিনি পূর্ব, পশ্চিম ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন)।
ভারতের প্রেসিডেন্ট Dr. S. Radha Krishan 1962 সালে সরোজিনী সম্পর্কে বলেছেন- A vivid, warm, vital and intense personality, She learned? radiance and benevolence wherever she was. She was the most outstanding Indian woman of her generation. Sarojini Naidu embod-ied in herself the most valuable elements of India’s composite culture : Hindus, Buddhist, Muslim and British. She is a happy blend of the values of both East & West. (তাঁর চরিত্রে আন্তরিকতা ও স্পষ্টবাদিতার মহা মূল্যবান মিশ্রণ ছিল। তিনি দানশীল ও দীপ্তিমান এবং তাঁর সময়ে তিনি ভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা ছিলেন। তার চরিত্রে ভারতের বিভিন্ন স্থানের ও ধর্মমতের যৌগিক কৃষ্টির যথা- হিন্দু ও বৌদ্ধ, মুসলিম ও ব্রিটিশদের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি পূর্ব-পশ্চিমের গুণাবলির সেতু বন্ধনকারী ছিলেন।)
ভারতের দুই মহান নেতা জওহরলাল নেহরু এবং রাধাকৃষ্ণ অল্প কথায় সরোজিনীর যে মূল্যায়ন করেছেন তা যথার্থ। কবি সরোজিনী নাইডু জাতীয় স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে সরোজিনী নাইডুর কর্ম ও জীবনের ওপর রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়। প্রাবন্ধিক রওশন আরা তাঁর প্রবন্ধে লিখেন, ‘কংগ্রেস নেতা হিসেবে আমাদের ঢাকা নগরীতেও তিনি বেশ কয়েকবার বক্তৃতা করেছেন। ছুটে গেছেন পিতৃভূমি বিক্রমপুরের ব্রাহ্মণগাঁ গ্রামে। বিক্রমপুরের গৌরবগাথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরসহ ভারতবর্ষের যেখানেই গেছেন তিনি সেখানে পেয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনা। বাংলাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক প্রয়াত দেওয়ান আজরফের একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে জানা যায় সরোজিনী সিলেট ও সুনামগঞ্জ সফরকালে জনগণ তাকে কি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য যেন গোটা জেলা ও মহকুমার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। প্রচণ্ড ভিড় পেরিয়ে সভা মঞ্চে পৌছাতে সাহায্য করার জন্য সেদিন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুবক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে দারুণ হিমশিম খেতে হয়েছিল। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সরোজিনী নাইডু।
ঐ অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন- “এখনও আমার সরোজিনী নাইডুর কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসে। কি অলৌকিক মধুর ছিল তাঁর বাচনভঙ্গি। আমি তা গুছিয়ে বলতে পারবে না।” দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো তিনিও মনেপ্রাণে হিন্দু-মুসলমানদের মিলন কামনা করতেন, চাইতেন অনগ্রসর ভারতীয় মুসলমানদের উন্নতি। তৎকালীন ভারতের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। জিন্নাহ সাহেবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। পরবর্তীতে তাঁরা রাজনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল।
বোম্বাই সফরকালে সরোজিনী বরাবরই জিন্নার গাড়িতে উঠতেন। গভীর রাত্র অবধি তারা ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। ফাতেমা জিন্নাহও সে আলোচনায় অংশ নিতেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জিন্নাহ সাহেব হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য আন্তরিক প্রয়াস চালান। জিন্নাহ সাহেবের সে অকৃত্রিম আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে সরোজিনী নাইডু তাঁকে Ambassador of Hindu Muslim Unity বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। একদা একজন জীবনীকার লেখক সরোজিনীকে বললেন তিনি কতিপয় বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী লিখেছেন। সরোজিনী তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার তালিকায় জিন্নাহ সাহেবের নাম আছে কি-না? জিন্নাহ সাহেবের নাম নেই শুনে তিনি বিরক্ত হলেন এবং তাকে বললেন, তিনি একজন মহান নেতা তাঁর নাম অবশ্যই থাকা উচিত ছিল।
এই মহীয়সী নারী আজীবন নারীমুক্তি, যুবকল্যাণ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ধারণ করে গেছেন। বিক্রমপুরের এই কন্যা তাঁর কীর্তি ও সাহসের মাধ্যমে সমগ্র মহিলাজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও সম্মানিত।
উল্লেখ: লেখাটির বেশিরভাগ অংশ নেয়া হয়েছে কবি সরোজিনী নাইডু জাতীয় স্মৃতি পরিষদ কতৃক প্রকাশিত ‘বিক্রমপুর কন্যা সরোজিনী নাইডু বই থেকে।