প্রকৃতি থেকে বিলীনের পথে জোনাকি

নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
২৪ এপ্রিল, ২০২৫, 5:53 PM

প্রকৃতি থেকে বিলীনের পথে জোনাকি
একসময়ে গ্রামীন জনপদে আঁধার নেমে আসলেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রাম্য প্রকৃতি জুড়ে তারার মতো মিটমিটে আলো জ্বালিয়ে রাতের নিরবতাকে মোহনীয় করে তুলতো প্রানীজ বিদ্যুৎ নামে খ্যাত ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা। অথচ কালের বিবর্তনে ক্রমেই বিলুপ্তির পথে জোনাকি পোকা।
শহুরে জীবনে এদের দেখা একটু কম মিললেও একসময়ে প্রায় প্রতি রাতে আঁধার মাঝে গ্রামীণ প্রকৃতির চারপাশে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো যেন এক পতঙ্গ পোকাদের উৎসবের আমেজ। এ দৃশ্য যেন গ্রামীন জনপদের অন্ধকার প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমাগত আলো দূষণ, আগাছা দমন, কৃষি জমিতে কীটনাশক ও কেমিক্যালের অবাধ ব্যবহার, পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং খাল-বিল ও পুকুরে খামার ভিত্তিক মাছ চাষের কারণে জোনাকির খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক প্রজনন এবং নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ায় আলোর বাহক নিশাচর জোনাকিরা দিন দিন নিজেদের আলো নিভিয়ে আজ অন্ধকার পথের যাত্রী।
সপ্তাহ জুড়ে রাতের আঁধারে সরেজমিনে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তারা জানান, বছর পনেরো আগেও গ্রামে-গঞ্জে সন্ধ্যার পর পুকুর, খাল-বিল, ডোবার পাড়ের ঝোপঝাড়, জঙ্গল আর গাছগাছালির ফাঁকে নিজেদের আলোয় জ্বলে উঠতো জোনাকির ঝাঁক।
তারা বলেন, এক সময়ে ভ্যাপসা গরমের সাথে সন্ধ্যায় ঝিরঝির হিমেল হাওয়ায় গ্রামের প্রকৃতিতে মিটিমিটি আলো জ্বেলে দোল খেতো জোনাকির ঝাঁক। গ্রামীণ জনপদে এ যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তবে বর্তমানে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ জনজীবনেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও মানুষের অত্যাচারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির আলো এখন আর চোখে পড়ে না।
বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের বাংলা সাহিত্য বিষয়ের সিনিয়র প্রভাষক লুৎফুন্নাহার লায়লা বলেন, কয়েক বছর আগেও গ্রামীণ জনপদে সচরাচর জোনাকি পোকা দেখা যেতো। তবে সম্প্রতি সময়ে সেই জোনাকির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। যার মূল কারণ হিসেবে রয়েছে আলোক দূষণ, জোনাকির বাসস্থান ধ্বংস, কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের অতিরিক্ত প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জৈবিক বৈচিত্রের অভাব। এসব কারণে কেবল জোনাকিই নয়, এমন অনেক ধরনের প্রাণি ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। তাই এসব সমস্যাগুলো সমাধান করতে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জীববৈচিত্র রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের খুব দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
নেত্রকোনা সরকারি কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তফাজ্জল হোসেন আকন্দ বলেন, জোনাকি মূলত বিটল শ্রেণির বাদামি পোকা। যাকে ইংরেজিতে ‘লাইটিং বাগ বা ফায়ার ফ্লাই’ বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম (Nippon Lucia Crociata)। ছোট কালচে বাদামি রঙের এই পোকা দেখতে অনেকটা লম্বাটে গড়নের। যা লম্বায় প্রায় দুই সেঃমিঃ হয়ে থাকে। এসব জোনাকির ছয়টি পা, দুইটি অ্যান্টেনা, অক্ষিগোলক আর শরীর তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। জোনাকির লেজে এন লুসিফেরাজ এবং লুসিফেরিন এনজাইম থাকে, যা থেকে আলো ছড়ায়। আলো ছড়ানোর মূল কারণ মানুষকে খুশি করা নয় বরং পুরুষ জোনাকি আলো জ্বালিয়ে স্ত্রী জোনাকিকে আকর্ষণ করে এবং পরে যৌন মিলন ঘটায়।
তিনি আরও বলেন, জলচর অনেক প্রাণির এমন আলো জ্বালানোর ক্ষমতা থাকলেও স্থলচর প্রাণির মধ্যে জোনাকিই একমাত্র আলো জ্বালানোর ক্ষমতা রাখে। দিনের বেলায় এসব জোনাকিরা পুকুর, ডোবা, খাল-বিল ও নদী পাড়ের লতা-ঘাস এবং ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। এসব জোনাকি ক্ষুদ্রাকারের। যারা কেঁচো, শামুকের ডিম বা পচা প্রাণি ও আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে বয়স্ক জোনাকিদের প্রিয় খাবার গাছের ফুল-ফলের মধু ও রস।
সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল শৈশবে জেনাকির সাথে সখ্যতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছেলে বেলায় আমাদের গ্রামীণ জনপদে সন্ধ্যা নামলেই বন্ধুরা মিলে জোনাকির আলোর পিছু পিছু ছুটতাম। হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে আবার উড়িয়ে দিতাম। রহস্য খুঁজতে উল্টেপাল্টে দেখতাম, কীভাবে একটি পোকার পেট থেকে আলো বের হয়। জোনাকি নিয়ে এমন কতশত স্মৃতি জমা আছে আমাদের দূরন্ত শৈশবের স্মৃতিপটে। এখন আর জোনাকির পেছনে দৌড়ানো হয় না। হাতে নিয়ে দেখা হয় না জোনাকির আলো, হয়তো বড় হয়েছি বলে।
তিনি আরও বলেন, শৈশবে জোনাকির আলো নিয়ে খেলা করেনি এমন মানুষ খুব কম রয়েছে, বিশেষ করে যারা গ্রামে বসবাস করেছেন। তখন গ্রামাঞ্চালে ঝোপঝাড় ও বাঁশ বাগানের ব্যাপক বিস্তৃতি থাকায় জোনাকির উপস্থিতিও বেশি ছিল। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঝোপঝাড়, বাঁশ বাগান কমে গেছে, বেড়েছে মানুষের ঘনবসতি। যার ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বনায়ন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া এখন খুবই জরুরি।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
২৪ এপ্রিল, ২০২৫, 5:53 PM

একসময়ে গ্রামীন জনপদে আঁধার নেমে আসলেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রাম্য প্রকৃতি জুড়ে তারার মতো মিটমিটে আলো জ্বালিয়ে রাতের নিরবতাকে মোহনীয় করে তুলতো প্রানীজ বিদ্যুৎ নামে খ্যাত ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা। অথচ কালের বিবর্তনে ক্রমেই বিলুপ্তির পথে জোনাকি পোকা।
শহুরে জীবনে এদের দেখা একটু কম মিললেও একসময়ে প্রায় প্রতি রাতে আঁধার মাঝে গ্রামীণ প্রকৃতির চারপাশে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো যেন এক পতঙ্গ পোকাদের উৎসবের আমেজ। এ দৃশ্য যেন গ্রামীন জনপদের অন্ধকার প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমাগত আলো দূষণ, আগাছা দমন, কৃষি জমিতে কীটনাশক ও কেমিক্যালের অবাধ ব্যবহার, পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং খাল-বিল ও পুকুরে খামার ভিত্তিক মাছ চাষের কারণে জোনাকির খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক প্রজনন এবং নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ায় আলোর বাহক নিশাচর জোনাকিরা দিন দিন নিজেদের আলো নিভিয়ে আজ অন্ধকার পথের যাত্রী।
সপ্তাহ জুড়ে রাতের আঁধারে সরেজমিনে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম ঘুরে ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তারা জানান, বছর পনেরো আগেও গ্রামে-গঞ্জে সন্ধ্যার পর পুকুর, খাল-বিল, ডোবার পাড়ের ঝোপঝাড়, জঙ্গল আর গাছগাছালির ফাঁকে নিজেদের আলোয় জ্বলে উঠতো জোনাকির ঝাঁক।
তারা বলেন, এক সময়ে ভ্যাপসা গরমের সাথে সন্ধ্যায় ঝিরঝির হিমেল হাওয়ায় গ্রামের প্রকৃতিতে মিটিমিটি আলো জ্বেলে দোল খেতো জোনাকির ঝাঁক। গ্রামীণ জনপদে এ যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তবে বর্তমানে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ জনজীবনেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও মানুষের অত্যাচারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির আলো এখন আর চোখে পড়ে না।
বারহাট্টা সরকারি ডিগ্রি কলেজের বাংলা সাহিত্য বিষয়ের সিনিয়র প্রভাষক লুৎফুন্নাহার লায়লা বলেন, কয়েক বছর আগেও গ্রামীণ জনপদে সচরাচর জোনাকি পোকা দেখা যেতো। তবে সম্প্রতি সময়ে সেই জোনাকির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। যার মূল কারণ হিসেবে রয়েছে আলোক দূষণ, জোনাকির বাসস্থান ধ্বংস, কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের অতিরিক্ত প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জৈবিক বৈচিত্রের অভাব। এসব কারণে কেবল জোনাকিই নয়, এমন অনেক ধরনের প্রাণি ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। তাই এসব সমস্যাগুলো সমাধান করতে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জীববৈচিত্র রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের খুব দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
নেত্রকোনা সরকারি কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক তফাজ্জল হোসেন আকন্দ বলেন, জোনাকি মূলত বিটল শ্রেণির বাদামি পোকা। যাকে ইংরেজিতে ‘লাইটিং বাগ বা ফায়ার ফ্লাই’ বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম (Nippon Lucia Crociata)। ছোট কালচে বাদামি রঙের এই পোকা দেখতে অনেকটা লম্বাটে গড়নের। যা লম্বায় প্রায় দুই সেঃমিঃ হয়ে থাকে। এসব জোনাকির ছয়টি পা, দুইটি অ্যান্টেনা, অক্ষিগোলক আর শরীর তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। জোনাকির লেজে এন লুসিফেরাজ এবং লুসিফেরিন এনজাইম থাকে, যা থেকে আলো ছড়ায়। আলো ছড়ানোর মূল কারণ মানুষকে খুশি করা নয় বরং পুরুষ জোনাকি আলো জ্বালিয়ে স্ত্রী জোনাকিকে আকর্ষণ করে এবং পরে যৌন মিলন ঘটায়।
তিনি আরও বলেন, জলচর অনেক প্রাণির এমন আলো জ্বালানোর ক্ষমতা থাকলেও স্থলচর প্রাণির মধ্যে জোনাকিই একমাত্র আলো জ্বালানোর ক্ষমতা রাখে। দিনের বেলায় এসব জোনাকিরা পুকুর, ডোবা, খাল-বিল ও নদী পাড়ের লতা-ঘাস এবং ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। এসব জোনাকি ক্ষুদ্রাকারের। যারা কেঁচো, শামুকের ডিম বা পচা প্রাণি ও আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকে। তবে বয়স্ক জোনাকিদের প্রিয় খাবার গাছের ফুল-ফলের মধু ও রস।
সাংবাদিক শ্যামলেন্দু পাল শৈশবে জেনাকির সাথে সখ্যতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছেলে বেলায় আমাদের গ্রামীণ জনপদে সন্ধ্যা নামলেই বন্ধুরা মিলে জোনাকির আলোর পিছু পিছু ছুটতাম। হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে আবার উড়িয়ে দিতাম। রহস্য খুঁজতে উল্টেপাল্টে দেখতাম, কীভাবে একটি পোকার পেট থেকে আলো বের হয়। জোনাকি নিয়ে এমন কতশত স্মৃতি জমা আছে আমাদের দূরন্ত শৈশবের স্মৃতিপটে। এখন আর জোনাকির পেছনে দৌড়ানো হয় না। হাতে নিয়ে দেখা হয় না জোনাকির আলো, হয়তো বড় হয়েছি বলে।
তিনি আরও বলেন, শৈশবে জোনাকির আলো নিয়ে খেলা করেনি এমন মানুষ খুব কম রয়েছে, বিশেষ করে যারা গ্রামে বসবাস করেছেন। তখন গ্রামাঞ্চালে ঝোপঝাড় ও বাঁশ বাগানের ব্যাপক বিস্তৃতি থাকায় জোনাকির উপস্থিতিও বেশি ছিল। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঝোপঝাড়, বাঁশ বাগান কমে গেছে, বেড়েছে মানুষের ঘনবসতি। যার ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বনায়ন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া এখন খুবই জরুরি।