করাতি পেশা এখন ‘স’ মিলের দখলে

রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
০২ মার্চ, ২০২৫, 6:43 PM

করাতি পেশা এখন ‘স’ মিলের দখলে
কালের বিবর্তন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তনের কারণে করাতিদের গাছ কাটার দৃশ্য এখন এখন শুধুই স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম-গঞ্জের হাত করাতিদের পেশা এখন যান্ত্রিক ‘স'-মিলের দখলে।
নব্বই দশকেও করাতিদের গাছ কাটার দৃশ্য দেখতে গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ও ছেলেরা ভিড় করতো। গাছ কাটার একাগ্রতা ও মনোবল যোগাতে থাকতো করাতিদের নানান সুরের শব্দ (বলোরে বলো... হেইয়ো), কখনও নানান সুরে গানের তাল। আর ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন সবাই।
এক সময় নেত্রকোনা জেলার অধিকাংশ গ্রামেই করাতি সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিলো। মাঝে মাঝে শুকনো মৌসুমে পাশ্ববর্তী মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি, মদনসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে করাতিরা এসে ফেরি করে কাঠ চিরানোর কাজ করতেন। ছয়মাস সময় নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সকল কাজ সম্পন্ন করে আবার তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতেন তারা।
জেলার কয়েকটি উপজেলার প্রবীণ করাতির সাথে কথা বললে তারা বলেন, আজ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে যান্ত্রিক ‘স-মিলের তেমন একটা প্রভাব ছিল না। তখন বড় বড় গাছ কিংবা কাঠ কাটার জন্য নির্ভর করতে হতো আমাদের মতো করাতি সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর। আমরা যখন হাত করাত দিয়ে গাছ ও কাঠ কাটার কাজ করতাম, তখন মাঝারী সাইজের একটি কাঠ চিরতে তিনজনের সময় লাগতো অন্তত দুইদিন। মজুরী হিসেবে পেতাম ২৫০০-৩০০০ টাকা। আর এখন আমাদের কাছে গাছ কাটাতে কেউ আসেই না, বরং ‘স’-মিলে নিয়ে যায় এবং অল্প টাকায়, অল্প সময়ে কাঠ চিরানো শেষ করে বাড়ি নিয়ে আসে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা যান্ত্রিক ‘স’-মিল আমাদের এই করাতি পেশাকে দখলে নিয়েছে। তাই আমরা করাতি পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
তারা আরও বলেন, আগে গাছের শক্ত মোটা ডাল আর পাটের রশি দিয়ে তৈরী করা হতো একটি কাঠমো। আর তার উপরেই রাখা হতো একটি বড় আকারের গাছ। গাছের উপরের অংশে অবস্থান করতো একজন আর নীচে অবস্থান করতো দুইজন। তিনজন মিলে হাতলযুক্ত করাত দিয়ে উপর-নীচে টেনে ছন্দে-ছন্দে চিরতাম বড় বড় গাছ। করাত এবং কাঠের ঘর্ষণের ফলে নীচে ঝরে পড়তো কাঠের গুড়ো। বর্তমানে কালের বিবর্তন ও প্রযুক্তির বিকাশে যে সকল পেশা এখন বিলুপ্ত তার মধ্যে অন্যতম আমাদের করাতি পেশা।
বারহাট্টা উপজেলার গবিন্দপুর গ্রামের প্রবীণ করাতি আব্দুল জলিল, শুক্কুর আলীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে আমরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে আমাদের বাবা, কাকারা এ কাজ করতেন। বাবা, কাকাদের মৃত্যুর পর থেকে আমরা এ কাজ করে আসছি। এখন আমরা শুধু গাছ কেটে টুকরো করে ‘স’-মিলে পৌঁছে দেই। তবে শুধু এ পেশার উপর নির্ভর করে টিকে থাকা এখন আর কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। তাই এ কাজের পাশাপাশি গৃহস্থের কাজ করি। কথা হয় বড়গাওয়া গ্রামের করাতি জীবন দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে বাপ দাদার সঙ্গে কাজ করতাম এখন আধুনিক করাতকল স্থাপন হওয়ায় ওই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন সদরের রেলগেট এলাকার এক করাতকলে কাজ করে সংসার চালাই।
গাছ ব্যাপারি আক্কাস আলী বলেন, আমি বিভিন্ন এলাকায় গাছ কিনে করাতিদের দিয়ে আসতো গাছ কাটিয়ে টুকরো করিয়ে বিভিন্ন ‘স’-মিলে বিক্রি করি।
জেলা সদরের সাতপাই এলাকার ‘স’-মিল মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, আমার ‘স’-মিলে যে গাছ বেপারিরা কাঠ দেন, তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গাছ কিনে তা কেটে বড় বড় টুকরো করে আমার মিলে বিক্রি করে। পরে গাছের বড় বড় টুকরো গুলো ক্রেতাদে চাহিদা অনুযায়ী করাত কল দিয়ে ফালি করে বিক্রি করি। এতে আমাদের মতো ‘স’-মিল মালিকদের সরাসরি করাতিদের কাছে যেতে হয় না।
রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
০২ মার্চ, ২০২৫, 6:43 PM

কালের বিবর্তন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তনের কারণে করাতিদের গাছ কাটার দৃশ্য এখন এখন শুধুই স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম-গঞ্জের হাত করাতিদের পেশা এখন যান্ত্রিক ‘স'-মিলের দখলে।
নব্বই দশকেও করাতিদের গাছ কাটার দৃশ্য দেখতে গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ও ছেলেরা ভিড় করতো। গাছ কাটার একাগ্রতা ও মনোবল যোগাতে থাকতো করাতিদের নানান সুরের শব্দ (বলোরে বলো... হেইয়ো), কখনও নানান সুরে গানের তাল। আর ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন সবাই।
এক সময় নেত্রকোনা জেলার অধিকাংশ গ্রামেই করাতি সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিলো। মাঝে মাঝে শুকনো মৌসুমে পাশ্ববর্তী মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি, মদনসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে করাতিরা এসে ফেরি করে কাঠ চিরানোর কাজ করতেন। ছয়মাস সময় নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সকল কাজ সম্পন্ন করে আবার তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতেন তারা।
জেলার কয়েকটি উপজেলার প্রবীণ করাতির সাথে কথা বললে তারা বলেন, আজ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে যান্ত্রিক ‘স-মিলের তেমন একটা প্রভাব ছিল না। তখন বড় বড় গাছ কিংবা কাঠ কাটার জন্য নির্ভর করতে হতো আমাদের মতো করাতি সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর। আমরা যখন হাত করাত দিয়ে গাছ ও কাঠ কাটার কাজ করতাম, তখন মাঝারী সাইজের একটি কাঠ চিরতে তিনজনের সময় লাগতো অন্তত দুইদিন। মজুরী হিসেবে পেতাম ২৫০০-৩০০০ টাকা। আর এখন আমাদের কাছে গাছ কাটাতে কেউ আসেই না, বরং ‘স’-মিলে নিয়ে যায় এবং অল্প টাকায়, অল্প সময়ে কাঠ চিরানো শেষ করে বাড়ি নিয়ে আসে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা যান্ত্রিক ‘স’-মিল আমাদের এই করাতি পেশাকে দখলে নিয়েছে। তাই আমরা করাতি পেশা ছেড়ে দিয়েছি।
তারা আরও বলেন, আগে গাছের শক্ত মোটা ডাল আর পাটের রশি দিয়ে তৈরী করা হতো একটি কাঠমো। আর তার উপরেই রাখা হতো একটি বড় আকারের গাছ। গাছের উপরের অংশে অবস্থান করতো একজন আর নীচে অবস্থান করতো দুইজন। তিনজন মিলে হাতলযুক্ত করাত দিয়ে উপর-নীচে টেনে ছন্দে-ছন্দে চিরতাম বড় বড় গাছ। করাত এবং কাঠের ঘর্ষণের ফলে নীচে ঝরে পড়তো কাঠের গুড়ো। বর্তমানে কালের বিবর্তন ও প্রযুক্তির বিকাশে যে সকল পেশা এখন বিলুপ্ত তার মধ্যে অন্যতম আমাদের করাতি পেশা।
বারহাট্টা উপজেলার গবিন্দপুর গ্রামের প্রবীণ করাতি আব্দুল জলিল, শুক্কুর আলীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে আমরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে আমাদের বাবা, কাকারা এ কাজ করতেন। বাবা, কাকাদের মৃত্যুর পর থেকে আমরা এ কাজ করে আসছি। এখন আমরা শুধু গাছ কেটে টুকরো করে ‘স’-মিলে পৌঁছে দেই। তবে শুধু এ পেশার উপর নির্ভর করে টিকে থাকা এখন আর কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। তাই এ কাজের পাশাপাশি গৃহস্থের কাজ করি। কথা হয় বড়গাওয়া গ্রামের করাতি জীবন দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে বাপ দাদার সঙ্গে কাজ করতাম এখন আধুনিক করাতকল স্থাপন হওয়ায় ওই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন সদরের রেলগেট এলাকার এক করাতকলে কাজ করে সংসার চালাই।
গাছ ব্যাপারি আক্কাস আলী বলেন, আমি বিভিন্ন এলাকায় গাছ কিনে করাতিদের দিয়ে আসতো গাছ কাটিয়ে টুকরো করিয়ে বিভিন্ন ‘স’-মিলে বিক্রি করি।
জেলা সদরের সাতপাই এলাকার ‘স’-মিল মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, আমার ‘স’-মিলে যে গাছ বেপারিরা কাঠ দেন, তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গাছ কিনে তা কেটে বড় বড় টুকরো করে আমার মিলে বিক্রি করে। পরে গাছের বড় বড় টুকরো গুলো ক্রেতাদে চাহিদা অনুযায়ী করাত কল দিয়ে ফালি করে বিক্রি করি। এতে আমাদের মতো ‘স’-মিল মালিকদের সরাসরি করাতিদের কাছে যেতে হয় না।