আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের সোনালী দিন
রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
১৪ নভেম্বর, ২০২৫, 7:30 PM
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের সোনালী দিন
‘চলিতেছ… চলিতেছে..’ এবং পরবর্তী আকর্ষণ ‘আসিতেছে....’ আসিতেছে...’ সাথে ছায়াছবির সংলাপ। একসময়ে ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। তখন মানুষ পরিবার পরিজনসহ দল বেঁধে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতো। কিন্তু বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় টেলিভিশন, ক্যাবল লাইন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের দাপটে হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের বড় পর্দায় সিনেমা দেখার পুরোনোঐতিহ্যের সোনালি সেই দিনগুলো।
নব্বইয়ের দশকে দর্শকদের কাছে সিনেমা হলে চলা সিনেমার বার্তা প্রচারের জন্য রিকশায় মাইক ঝুলিয়ে রিকশার দু’পাশে চাটাইয়ে পোস্টার ঝুলিয়ে এলাকার মূল সড়ক, গ্রাম-গঞ্জের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার আনাছে-কানাছে, মাইকিংয়ে, মাইকিংয়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ। রিকশায় বসা মাইকিং ম্যানের কন্ঠে বিভিন্ন আওয়াজে ভেসে আসতো ফাইট, এ্যাকশান, সংলাপ, হাঁসি-কান্না, ও বাংলা ছায়াছবির গানের ফাঁকে, ফাঁকে বলা হতো- চলিতেছ… চলিতেছে.. এবং পরবর্তী আকর্ষণ আসিতেছে.. আসিতেছে.. ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ছায়াছবির পোস্টারিং ছিলো বিদ্যুতের খুটি, দেয়ালে, রাস্তার ধারে ধারির চাটাইয়ে। অথচ কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই আওয়াজ করা বাংলা ছায়াছবির মাইকিং আর শুনা যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা হয় না বাংলা ছায়াছবির পোস্টারিং। হলগুলোতে তখন সময়ের কাটা হিসেব করে দিন-রাত চলতো একের পর এক শো। মর্নিং শো- দুপুর ১২ টায়, ইভিনিং শো- সন্ধ্যা ৬ টায় এবং রাত ১২ টায় নাইট শো চলতো হলগুলোতে। মফস্বলের হলগুলোতে বসার সিটগুলোকে তিন স্তরে ভাগ করা হতো (ডিসি, প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি) দর্শকের সংখ্যা বেশি হলে কখনো কখনো হলের সামনে সাইনবোর্ডে টানানো হতো হাউসফুল।
দর্শক, সিনেমা হল মালিক ও সিনেমা হল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা জানান, নব্বইয়ের দশক ছিলো বাংলা সিনেমার সোনালী যুগ। তবে সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার কদর, হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের যৌবন-জৌলুশ। টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেটের দাপটে দিন দিন দর্শক ভাটা পড়েছে এক সময়ের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা হলগুলোতে। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে সিনেমা হলগুলো আধুনিক যুগের স্রোতের সাথে তাল মিলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ সিনেমা হল।
তারা বলেন, সিনেমা হলগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারানো নয় বরং একটি ঐতিহ্য, একটি মিলনমেলা, একটি যুগের স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই হলগুলোর অস্তিত্ব অজানাই থেকে যাচ্ছে। অথচ সংরক্ষণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এগুলোকে ফিরিয়ে আনা যেতো নতুন রূপে, নতুন প্রাণে।
বারহাট্টা উপজেলা সদরের স্থানীয় বাসিন্দা ও সিনেমা প্রেমী মো. কামরুজ্জামান, বেলাল হোসেন, বাউসী এলাকার সাজ্জাদ মিয়া, মুকুল সরকার, বিক্রমশ্রী এলাকার জানু মিয়া, সাহতা এলাকার আক্কাস আলী, মনোরঞ্জন দাসের সাথে কথা বললে তারা সকালের সময়কে বলেন, আমাদের বারহাট্টায় একটি মাত্র সিনেমা হল ছিল (মাধবী) পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে ‘আঁচল’ নাম হয়েছিল। এই সিনেমা হলটি শুধু বিনোদনের জায়গা ছিল না, ছিল মানুষের সম্পর্ক গড়ার কেন্দ্রস্থল। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব, প্রেম, পরিবার সবকিছুরই সূচনা হয়েছে এই হলকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের বিনোদনের একমাত্র সিনেমা হলটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে বর্তমানে বসত বাড়িতে পরিনত হয়েছে।
তারা আরও বলেন, আমাদের উপজেলার অন্যতম পুরোনো ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন কেন্দ্র হিসাবে একটি মাত্র সিনেমা হল’ই ছিল। বারহাট্টার হল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা মোহনগঞ্জে তিনটা হলে (দিলশাদ, মিতালী ও কংকন) এবং নেত্রকোনা শহরেরর দুইটা হলে (হাসনা, হেনা) পরবর্তীতে দুইটা মিলে হীরামন নামকরণ করা হয়। আমরা সমবয়সী বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম হলগুলোতে। শুক্রবার থেকে শুরু করে ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে সিনেমা হলগুলোতে উপচে পড়ত দর্শকের ভিড়। সেইসব দিনে দর্শকেরা দেখতে পেতেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সিনেমার জনপ্রিয় জসিম, রাজ্জাক, আলমগীর, শাবানা, সুচরিতা, কবরী কিংবা আধুনিক যুগের মান্না, সালমান শাহ’র অভিনীত সিনেমা। সে সময়ে পরিবার, বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে হলমুখী হওয়া ছিল এক সামাজিক মেলবন্ধনের উপলক্ষ্য। শুধু সিনেমা দেখা নয়, বরং এটি ছিল এক ধরনের আনন্দ উৎসব। কিন্তু সময় এখন বদলেগেছে।
উপজেলার রায়পুর গ্রামের রিকশা চালক মৌজ আলী (৭০), নিবারণ দাস (৭৫) ও ডেমুরা গ্রামের ভ্যান চালক নান্টু মিয়া, দশাল গ্রামের বাস হেলপার জজ মিয়া বলেন, আজ থেকে ৪০ বছর আগে সিনেমা হলের চারপাশে মানুষের ভীড় আর চিৎকার চেঁচামেচিই জানান দিতো সিনেমা হলে চলছে নতুন কোন ছবি। যার জন্য সিনেমা প্রেমী উৎসুক দর্শকের হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকতো পুরো সিনেমা হলের আশপাশের এলাকা কিন্তু বর্তমানে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন খুবই কষ্ট লাগে।
কথা হয় সত্তর বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী বিধান চন্দ্র দাসের সাথে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একসময়ে বিশেষ কোনো উপলক্ষে বা বিশেষ ছবি মুক্তি পেলে দর্শকরা সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে লাইন ধরত। টিকিট পেতেও অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। সিনেমা শুরু হলে ছায়াছবির বিশেষ কোনো দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে করতালিতে ভরে যেত পুরো হল। 'আগুনের পরশমণি', 'দাঙ্গা', 'বাবা কেন চাকর', 'জজ- ব্যারিস্টার', 'বেদের মেয়ে জোসনার মতো জনপ্রিয় ছবিতো দুই-তিন সপ্তাহ জুড়ে চলেছে। সেই সিনেমা হলগুলো তো এখন অস্তিত্বহারা। আঁচল, দিলশাদ, মিতালী, কংকন, হীরামন সিনেমা হলের মতো বেশিরভাগ সিনেমা হলই তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে দেশি সিনেমায়-ই তো এখন দুর্দিন চলছে।
পঞ্চাশোর্ধ বয়সী সিনেমাপ্রেমী ইকবাল মিয়া বলেন, বড় পর্দায় সিনেমা অনেক দেখেছি। টিকিট কেটে দেখেছি, টিকিট ছাড়াও দেখেছি যা এখন শুধুই স্মৃতি। আজও মনেপড়ে ঈদের দিন কিংবা শুক্রবারে একটি টিকিটের জন্য গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছি। শতজনের পিছনে লাইনে থেকে ঘন্টা খানেক পর টিকিট পেয়ে আনন্দ পেয়েছি। ভীড়ের মধ্যে ছাড়পোকার কামড়ে সিনেমা দেখে ঘামে শরীর ভিজে একাকার হলে শার্ট খুলে চিপে আবার গায়ে দিয়েছি। কিন্তু শত কষ্ট হলেও সিনেমা দেখা বন্ধ করিনি। সেই সময়ের কষ্টের স্মৃতি আমাদের জীবনে মধুর আনন্দের স্মৃতি।
এই বেহাল দশা নিয়ে আঁচল সিনেমা হলের মেশিন অপারেটর খাদেম আলী জানান, আমি ৪০ বছর আগে সিনেমা হলের অপারেটরের কাজ করেছি। সিনেমা হলে দর্শক না আসায় সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি এ পেশা ছেড়ে ঢাকাতে কোম্পানিতে কাজ করছি।
এই সিনেমা হলের আরেক স্টাফ গেটম্যান কার্তিক সরকার জানান, আমি.আঁচল সিনেমা হলে ৩৫ বছর চাকরি করেছি। পুরনো এই হলটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই জীবন চালাতে অন্য পেশা বেছে নিয়েছি।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক ফারুক বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে আমরা হয়ত চাইলেই সিনেমা দেখতে পারি হাতে ধরা মোবাইলের পর্দায়। কিন্তু হলের অন্ধকার ঘরে একসঙ্গে শ'খানেক মানুষের হাসিকান্না ভাগ করে নেওয়ার যে অভিজ্ঞতা, তার তুলনা নেই। সেই অভিজ্ঞতা, সেই ঐতিহ্যই যেন হারিয়ে না যায় এটাই সময়ের দাবি।
রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
১৪ নভেম্বর, ২০২৫, 7:30 PM
‘চলিতেছ… চলিতেছে..’ এবং পরবর্তী আকর্ষণ ‘আসিতেছে....’ আসিতেছে...’ সাথে ছায়াছবির সংলাপ। একসময়ে ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। তখন মানুষ পরিবার পরিজনসহ দল বেঁধে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতো। কিন্তু বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় টেলিভিশন, ক্যাবল লাইন, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের দাপটে হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের বড় পর্দায় সিনেমা দেখার পুরোনোঐতিহ্যের সোনালি সেই দিনগুলো।
নব্বইয়ের দশকে দর্শকদের কাছে সিনেমা হলে চলা সিনেমার বার্তা প্রচারের জন্য রিকশায় মাইক ঝুলিয়ে রিকশার দু’পাশে চাটাইয়ে পোস্টার ঝুলিয়ে এলাকার মূল সড়ক, গ্রাম-গঞ্জের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার আনাছে-কানাছে, মাইকিংয়ে, মাইকিংয়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ। রিকশায় বসা মাইকিং ম্যানের কন্ঠে বিভিন্ন আওয়াজে ভেসে আসতো ফাইট, এ্যাকশান, সংলাপ, হাঁসি-কান্না, ও বাংলা ছায়াছবির গানের ফাঁকে, ফাঁকে বলা হতো- চলিতেছ… চলিতেছে.. এবং পরবর্তী আকর্ষণ আসিতেছে.. আসিতেছে.. ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ছায়াছবির পোস্টারিং ছিলো বিদ্যুতের খুটি, দেয়ালে, রাস্তার ধারে ধারির চাটাইয়ে। অথচ কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই আওয়াজ করা বাংলা ছায়াছবির মাইকিং আর শুনা যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা হয় না বাংলা ছায়াছবির পোস্টারিং। হলগুলোতে তখন সময়ের কাটা হিসেব করে দিন-রাত চলতো একের পর এক শো। মর্নিং শো- দুপুর ১২ টায়, ইভিনিং শো- সন্ধ্যা ৬ টায় এবং রাত ১২ টায় নাইট শো চলতো হলগুলোতে। মফস্বলের হলগুলোতে বসার সিটগুলোকে তিন স্তরে ভাগ করা হতো (ডিসি, প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি) দর্শকের সংখ্যা বেশি হলে কখনো কখনো হলের সামনে সাইনবোর্ডে টানানো হতো হাউসফুল।
দর্শক, সিনেমা হল মালিক ও সিনেমা হল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা জানান, নব্বইয়ের দশক ছিলো বাংলা সিনেমার সোনালী যুগ। তবে সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার কদর, হারিয়ে গেছে সিনেমা হলের যৌবন-জৌলুশ। টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেটের দাপটে দিন দিন দর্শক ভাটা পড়েছে এক সময়ের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা হলগুলোতে। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে সিনেমা হলগুলো আধুনিক যুগের স্রোতের সাথে তাল মিলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ সিনেমা হল।
তারা বলেন, সিনেমা হলগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারানো নয় বরং একটি ঐতিহ্য, একটি মিলনমেলা, একটি যুগের স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই হলগুলোর অস্তিত্ব অজানাই থেকে যাচ্ছে। অথচ সংরক্ষণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এগুলোকে ফিরিয়ে আনা যেতো নতুন রূপে, নতুন প্রাণে।
বারহাট্টা উপজেলা সদরের স্থানীয় বাসিন্দা ও সিনেমা প্রেমী মো. কামরুজ্জামান, বেলাল হোসেন, বাউসী এলাকার সাজ্জাদ মিয়া, মুকুল সরকার, বিক্রমশ্রী এলাকার জানু মিয়া, সাহতা এলাকার আক্কাস আলী, মনোরঞ্জন দাসের সাথে কথা বললে তারা সকালের সময়কে বলেন, আমাদের বারহাট্টায় একটি মাত্র সিনেমা হল ছিল (মাধবী) পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে ‘আঁচল’ নাম হয়েছিল। এই সিনেমা হলটি শুধু বিনোদনের জায়গা ছিল না, ছিল মানুষের সম্পর্ক গড়ার কেন্দ্রস্থল। আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব, প্রেম, পরিবার সবকিছুরই সূচনা হয়েছে এই হলকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের বিনোদনের একমাত্র সিনেমা হলটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে বর্তমানে বসত বাড়িতে পরিনত হয়েছে।
তারা আরও বলেন, আমাদের উপজেলার অন্যতম পুরোনো ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন কেন্দ্র হিসাবে একটি মাত্র সিনেমা হল’ই ছিল। বারহাট্টার হল ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা মোহনগঞ্জে তিনটা হলে (দিলশাদ, মিতালী ও কংকন) এবং নেত্রকোনা শহরেরর দুইটা হলে (হাসনা, হেনা) পরবর্তীতে দুইটা মিলে হীরামন নামকরণ করা হয়। আমরা সমবয়সী বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম হলগুলোতে। শুক্রবার থেকে শুরু করে ঈদ কিংবা পূজার ছুটিতে সিনেমা হলগুলোতে উপচে পড়ত দর্শকের ভিড়। সেইসব দিনে দর্শকেরা দেখতে পেতেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সিনেমার জনপ্রিয় জসিম, রাজ্জাক, আলমগীর, শাবানা, সুচরিতা, কবরী কিংবা আধুনিক যুগের মান্না, সালমান শাহ’র অভিনীত সিনেমা। সে সময়ে পরিবার, বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে হলমুখী হওয়া ছিল এক সামাজিক মেলবন্ধনের উপলক্ষ্য। শুধু সিনেমা দেখা নয়, বরং এটি ছিল এক ধরনের আনন্দ উৎসব। কিন্তু সময় এখন বদলেগেছে।
উপজেলার রায়পুর গ্রামের রিকশা চালক মৌজ আলী (৭০), নিবারণ দাস (৭৫) ও ডেমুরা গ্রামের ভ্যান চালক নান্টু মিয়া, দশাল গ্রামের বাস হেলপার জজ মিয়া বলেন, আজ থেকে ৪০ বছর আগে সিনেমা হলের চারপাশে মানুষের ভীড় আর চিৎকার চেঁচামেচিই জানান দিতো সিনেমা হলে চলছে নতুন কোন ছবি। যার জন্য সিনেমা প্রেমী উৎসুক দর্শকের হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকতো পুরো সিনেমা হলের আশপাশের এলাকা কিন্তু বর্তমানে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন খুবই কষ্ট লাগে।
কথা হয় সত্তর বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী বিধান চন্দ্র দাসের সাথে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একসময়ে বিশেষ কোনো উপলক্ষে বা বিশেষ ছবি মুক্তি পেলে দর্শকরা সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে লাইন ধরত। টিকিট পেতেও অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। সিনেমা শুরু হলে ছায়াছবির বিশেষ কোনো দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে করতালিতে ভরে যেত পুরো হল। 'আগুনের পরশমণি', 'দাঙ্গা', 'বাবা কেন চাকর', 'জজ- ব্যারিস্টার', 'বেদের মেয়ে জোসনার মতো জনপ্রিয় ছবিতো দুই-তিন সপ্তাহ জুড়ে চলেছে। সেই সিনেমা হলগুলো তো এখন অস্তিত্বহারা। আঁচল, দিলশাদ, মিতালী, কংকন, হীরামন সিনেমা হলের মতো বেশিরভাগ সিনেমা হলই তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে দেশি সিনেমায়-ই তো এখন দুর্দিন চলছে।
পঞ্চাশোর্ধ বয়সী সিনেমাপ্রেমী ইকবাল মিয়া বলেন, বড় পর্দায় সিনেমা অনেক দেখেছি। টিকিট কেটে দেখেছি, টিকিট ছাড়াও দেখেছি যা এখন শুধুই স্মৃতি। আজও মনেপড়ে ঈদের দিন কিংবা শুক্রবারে একটি টিকিটের জন্য গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছি। শতজনের পিছনে লাইনে থেকে ঘন্টা খানেক পর টিকিট পেয়ে আনন্দ পেয়েছি। ভীড়ের মধ্যে ছাড়পোকার কামড়ে সিনেমা দেখে ঘামে শরীর ভিজে একাকার হলে শার্ট খুলে চিপে আবার গায়ে দিয়েছি। কিন্তু শত কষ্ট হলেও সিনেমা দেখা বন্ধ করিনি। সেই সময়ের কষ্টের স্মৃতি আমাদের জীবনে মধুর আনন্দের স্মৃতি।
এই বেহাল দশা নিয়ে আঁচল সিনেমা হলের মেশিন অপারেটর খাদেম আলী জানান, আমি ৪০ বছর আগে সিনেমা হলের অপারেটরের কাজ করেছি। সিনেমা হলে দর্শক না আসায় সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি এ পেশা ছেড়ে ঢাকাতে কোম্পানিতে কাজ করছি।
এই সিনেমা হলের আরেক স্টাফ গেটম্যান কার্তিক সরকার জানান, আমি.আঁচল সিনেমা হলে ৩৫ বছর চাকরি করেছি। পুরনো এই হলটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই জীবন চালাতে অন্য পেশা বেছে নিয়েছি।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক ফারুক বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে আমরা হয়ত চাইলেই সিনেমা দেখতে পারি হাতে ধরা মোবাইলের পর্দায়। কিন্তু হলের অন্ধকার ঘরে একসঙ্গে শ'খানেক মানুষের হাসিকান্না ভাগ করে নেওয়ার যে অভিজ্ঞতা, তার তুলনা নেই। সেই অভিজ্ঞতা, সেই ঐতিহ্যই যেন হারিয়ে না যায় এটাই সময়ের দাবি।