গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তালপাতার পাখা

নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
২০ এপ্রিল, ২০২৫, 2:05 AM

গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী তালপাতার পাখা
তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু এখন আগের মতো খুব একটা দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বৈদ্যুতিক ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনারসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক ও ফাইবারের তৈরি হাতপাখার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড গরমে এক সময়ের দেহমনে শান্তির পরশ বোলানো বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা।
এক সময়ে চৈত্র-বৈশাখ আর গরমের সময়ে গ্রামবাংলায় সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। গরমের দিনে সন্ধ্যার পর খোলা আকাশের নিচে তালপাতার পাখা হাতে শীতল পাটিতে বসে গ্রাম্য মহিলাদের গল্প গুজবের দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেতো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচন্ড গরমে স্ত্রী তার স্বামীকে তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হওয়া ছিল চিরচেনা এক দৃশ্য। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও শহরে মানুষের কাছে তালপাতার তৈরি হাতপাখা না দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও পওয়া যায় এ পাখা। গরমে শহরে বিদ্যুতের বেশি লোডশেডিং না হলেও গ্রামাঞ্চলে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়েই হয়। তাই গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হলে এখনও এই হাতপাখার বাতাস যেন মানুষকে স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। আধুনিক সভ্যতার দাপটে গ্রাম-বাংলার তালপাতার পাখা শিল্প আজ অস্তিত্বের সংকটে। ভবিষ্যতে পাখার ব্যবহার থাকবে কিনা তা বলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে জেলা সদরসহ দশ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকার হাতপাখা তৈরীর পেশাদার কারিগররা পাখা বানানো বন্ধ করে দিয়ে অন্য পেশায় বেছে নিয়েছেন।
পাখা বানানোর ব্যবসা বন্ধ করার কারণ হিসাবে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পাড়ার পাখা তৈরির কারিগর সুরঞ্জন সিংহ, অমর ক্ষত্রিয়, মন্টু হাজং, নিলু সাংমার সাথে কথা বললে তারা বলেন, আগে পাখা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে যা রোজগার হতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। এখন কেউ আর আগের মতো পাখা কিনতে চায় না। এলাকায় আগের তুলনায় তাল গাছের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। তাছাড়া, বাঁশও কিনতে হয় চড়া দামে। ৩-৪ বছর আগে বেতের বাঁশ ১০০-২০০ টাকা দিয়ে কিনা গেলেও এখন সেই বাঁশ কিনতে হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। বাড়তি খরচ আর পরিশ্রম করে প্রতিটি হাতপাখা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করে খুব একটা লাভ হয় না।
তারা আরও বলেন, কাঁচামাল সংকট ও মুনাফা কম হওয়ায় অনেক কারিগররা এই পেশা পাল্টে ফেলছেন। যারা এখনও এ পেশায় টিকে আছেন বর্তমানে তাদের অবস্থা ভালো নয়। কোনো রকমে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়তই তারা সংগ্রাম করছে চলছেন। আবার কেউ কেউ বাংলার বিভিন্ন উৎসবে হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সম্বল করে তৈরি করছেন তাল পাতার পাখা। সরকারী সহায়তা পেলে আমার এই পেশাকে আরো বড় করতে পারতাম। আমরা চাই প্রাচীন এই ঐতিহ্য টিকে থাকুক আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বারহাট্টা উপজেলা সদরের কাশবন গ্রামের ৭০ বছর বয়সী কৃষক অবনী সরকার বলেন, আগে আমাদের মত কৃষকরা কাঠফাটা রোদে ফসলের মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচন্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতাম। তখনকার সময়ে তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহারে তালপাতার পাখার চাহিদা প্রায় বিলুপ্ত হয়েগেছে।
জেলা সদরের বাসিন্দা ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সাহিত্যিক যতীন সরকারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, '৯০' দশকে জেলা সদরসহ বিভিন্ন্ উপজেলা সদরের কিছু অংশ ছাড়া পল্লী গ্রমে বিদ্যুতের প্রসার ঘটেনি তখন সবার বাড়িতে বাড়িতে ছিল তালপাতার পাখা। তখন বাড়িতে অতিথি কিংবা বিশিষ্টজন কেউ আসলে প্রথমই হাতপাখার বাতাসের মাধ্যমেই অতিথিকে স্বাগত জানানো হতো। সেই সময় হাতপাখা ছাড়া কারও দিন চলত না। প্রচন্ড গরমে প্রাণ জুড়াতে তালপাতার পাখার জুড়ি ছিল না। এছাড়াও পড়ার সময়, খাবার সময় কিংবা ঘুমানোর সময়ে সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।
তিনি আরও বলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এ পাখার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তালপাতার হাতপাখা নিয়ে গ্রামবাংলার অতি পরিচিত প্রবাদ- 'তালের পাখা প্রাণের সখা শীতকালে হয় না দেখা, গরমকালে হয় যে দেখা।' এছাড়াও আমাদের মতো শিল্পী ও গান পাগল শ্রোতারা আজও ভুলে যাননি- প্রয়াত শিল্পী আকবর আলীর গাওয়া সেই বিখ্যাত রোমান্টিক গান- 'তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে, আরও কিছু সময় তুমি থাকো আমার পাশে।'
বর্তমানে তাল পাতার পাখার ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তালপাতার অপ্রতুলতা, উপকরণ সামগ্রীর (বেত, সুতা, রং, বাঁশ, মূলধন) মূল্যবৃদ্ধি ও ভালো বিপণন কেন্দ্রের অভাব, এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই শিল্প আবার নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
২০ এপ্রিল, ২০২৫, 2:05 AM

তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু এখন আগের মতো খুব একটা দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বৈদ্যুতিক ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনারসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক ও ফাইবারের তৈরি হাতপাখার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড গরমে এক সময়ের দেহমনে শান্তির পরশ বোলানো বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা।
এক সময়ে চৈত্র-বৈশাখ আর গরমের সময়ে গ্রামবাংলায় সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। গরমের দিনে সন্ধ্যার পর খোলা আকাশের নিচে তালপাতার পাখা হাতে শীতল পাটিতে বসে গ্রাম্য মহিলাদের গল্প গুজবের দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেতো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচন্ড গরমে স্ত্রী তার স্বামীকে তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হওয়া ছিল চিরচেনা এক দৃশ্য। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও শহরে মানুষের কাছে তালপাতার তৈরি হাতপাখা না দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও পওয়া যায় এ পাখা। গরমে শহরে বিদ্যুতের বেশি লোডশেডিং না হলেও গ্রামাঞ্চলে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়েই হয়। তাই গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হলে এখনও এই হাতপাখার বাতাস যেন মানুষকে স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। আধুনিক সভ্যতার দাপটে গ্রাম-বাংলার তালপাতার পাখা শিল্প আজ অস্তিত্বের সংকটে। ভবিষ্যতে পাখার ব্যবহার থাকবে কিনা তা বলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে জেলা সদরসহ দশ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকার হাতপাখা তৈরীর পেশাদার কারিগররা পাখা বানানো বন্ধ করে দিয়ে অন্য পেশায় বেছে নিয়েছেন।
পাখা বানানোর ব্যবসা বন্ধ করার কারণ হিসাবে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পাড়ার পাখা তৈরির কারিগর সুরঞ্জন সিংহ, অমর ক্ষত্রিয়, মন্টু হাজং, নিলু সাংমার সাথে কথা বললে তারা বলেন, আগে পাখা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে যা রোজগার হতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। এখন কেউ আর আগের মতো পাখা কিনতে চায় না। এলাকায় আগের তুলনায় তাল গাছের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। তাছাড়া, বাঁশও কিনতে হয় চড়া দামে। ৩-৪ বছর আগে বেতের বাঁশ ১০০-২০০ টাকা দিয়ে কিনা গেলেও এখন সেই বাঁশ কিনতে হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। বাড়তি খরচ আর পরিশ্রম করে প্রতিটি হাতপাখা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করে খুব একটা লাভ হয় না।
তারা আরও বলেন, কাঁচামাল সংকট ও মুনাফা কম হওয়ায় অনেক কারিগররা এই পেশা পাল্টে ফেলছেন। যারা এখনও এ পেশায় টিকে আছেন বর্তমানে তাদের অবস্থা ভালো নয়। কোনো রকমে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়তই তারা সংগ্রাম করছে চলছেন। আবার কেউ কেউ বাংলার বিভিন্ন উৎসবে হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সম্বল করে তৈরি করছেন তাল পাতার পাখা। সরকারী সহায়তা পেলে আমার এই পেশাকে আরো বড় করতে পারতাম। আমরা চাই প্রাচীন এই ঐতিহ্য টিকে থাকুক আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বারহাট্টা উপজেলা সদরের কাশবন গ্রামের ৭০ বছর বয়সী কৃষক অবনী সরকার বলেন, আগে আমাদের মত কৃষকরা কাঠফাটা রোদে ফসলের মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচন্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতাম। তখনকার সময়ে তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহারে তালপাতার পাখার চাহিদা প্রায় বিলুপ্ত হয়েগেছে।
জেলা সদরের বাসিন্দা ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সাহিত্যিক যতীন সরকারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, '৯০' দশকে জেলা সদরসহ বিভিন্ন্ উপজেলা সদরের কিছু অংশ ছাড়া পল্লী গ্রমে বিদ্যুতের প্রসার ঘটেনি তখন সবার বাড়িতে বাড়িতে ছিল তালপাতার পাখা। তখন বাড়িতে অতিথি কিংবা বিশিষ্টজন কেউ আসলে প্রথমই হাতপাখার বাতাসের মাধ্যমেই অতিথিকে স্বাগত জানানো হতো। সেই সময় হাতপাখা ছাড়া কারও দিন চলত না। প্রচন্ড গরমে প্রাণ জুড়াতে তালপাতার পাখার জুড়ি ছিল না। এছাড়াও পড়ার সময়, খাবার সময় কিংবা ঘুমানোর সময়ে সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।
তিনি আরও বলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এ পাখার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তালপাতার হাতপাখা নিয়ে গ্রামবাংলার অতি পরিচিত প্রবাদ- 'তালের পাখা প্রাণের সখা শীতকালে হয় না দেখা, গরমকালে হয় যে দেখা।' এছাড়াও আমাদের মতো শিল্পী ও গান পাগল শ্রোতারা আজও ভুলে যাননি- প্রয়াত শিল্পী আকবর আলীর গাওয়া সেই বিখ্যাত রোমান্টিক গান- 'তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে, আরও কিছু সময় তুমি থাকো আমার পাশে।'
বর্তমানে তাল পাতার পাখার ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তালপাতার অপ্রতুলতা, উপকরণ সামগ্রীর (বেত, সুতা, রং, বাঁশ, মূলধন) মূল্যবৃদ্ধি ও ভালো বিপণন কেন্দ্রের অভাব, এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই শিল্প আবার নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে।