বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকালের সাক্ষী মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
১৫ মার্চ, ২০২৫, 5:28 AM

বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকালের সাক্ষী মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ
বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি হলো মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম (রহ.) মসজিদ। মসজিদটি সুলতানি শাসন আমলের স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণশৈলীতে নির্মিত। মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। বঙ্গে সেন বংশের পতন আর বিক্রমপুরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রামপালের সীমান্তবর্তী বর্তমান মিরকাদিম পৌরসভার কাজী কসবা (বর্তমান দরগা বাড়ি) গ্রামে ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট কারুকার্য খচিত নয়ানাভিরাম ৫৪২ বছরের পুরানো বাবা আদম মসজিদটির অবস্থান। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর - পশ্চিমে চার কিলোমিটার দূরে বাবা আদম মসজিদটি রয়েছে। মসজিদটি ছয়টি সম আকৃতির এবং একই রকম উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজে আচ্ছাদিত। ছয়টি গম্বুজ দুই সারিতে স্থাপিত। মসজিদটির নির্মাণশৈলী চমৎকার।
জনশ্রুতি এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিক্রমপুরে বল্লাল সেনের রাজত্ব কালে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা আধ্যাত্মিক সাধক শহীদ বাবা আদম ( রহ.) এর নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।
মসজিদটির নির্মাণশৈলির মধ্যে সুলতানি আমলের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণশৈলী রয়েছে। সুলতানী শাসনামলে নির্মিত মসজিদের ন্যায় বাবা আদমের মসজিদের কার্নিস ও ছাদ বক্রাকার। মসজিদটির নামকরণ নিয়ে কোন শিলালিপি নেই। তবে মসজিদের সামনের দেওয়ালে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান ফতে শাহের শাসনামলে সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মালিক কাফুর শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন পূণ্য অর্জনের জন্য।
১৪৭৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৪৮৩ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। শহীদ বাবা আদম (রহ.) এর শহীদ হবার ৩০০ বছরেরও বেশি সময় পরে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট বাবা আদম মসজিদটি আয়তাকার ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। উত্তর - দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট এবং পূর্ব - পশ্চিমে প্রস্থ ৩৬ ফুট। মসজিদের চার কোণায় চারটি অষ্ট কোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারের ধাপে ধাপে পাতলা ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর দেওয়াল ইট নির্মিত যার প্রশস্ততা প্রায় সাড়ে ৬ ফুট। দেওয়াল নির্মাণে ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি মাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছে ।
পুরো মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে লাল পোড়া মাটি দিয়ে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে দু‘পাশে দুইটি গ্রানাইড পাথরের ধূসর বর্ণের স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভ দুইটি মেঝে থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকৃতি এবং এর পর ষোল কোণাকৃতির। স্তম্ভ দুইটি এবং চার দেওয়ালের উপরই ছয়টি গম্বুজ দাঁড়িয়ে আছে।স্তম্ভের সাহায্যে পুর্ব - পশ্চিমে দুই সারিতে এবং উত্তর - দক্ষিণে তিন সারিতে বিভক্ত। অভ্যন্তরভাগে পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। প্রধান মেহরাব এবং দুই পাশের মেহরাব ও পাশের দেওয়ালে পোড়া মটির লতা পাতা , গোলাপফুল , ঝুলন্ত তক্তীর নকশা রয়েছে। তিনটি মেহরাবের উপরে চমৎকার দুস্তরে ধূসর বর্ণের কারুকাজ করা রয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালের পশ্চাৎভাগ বাইরের দিকে তিন স্তরে বর্ধিত। পেছনের বর্ধিতাংশটি সুন্দর টেরাকোটা অলংকরণে নকশাকৃত। মসজিদের সম্মুখভাগে তিনটি খিলানাকৃতির প্রবেশ পথ রয়েছে, এর উপরিভাগ সুন্দরভাবে খাজকাটা । ঝুলন্ত শিকল এবং ঘন্টার অলংকরণ রয়েছে। বর্তমানে শুধু মাঝের প্রবেশপথটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সেন রাজত্বের শেষ যুগে বাংলায় মুসলিম শক্তি চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠার পর বিজয়ী মুসলমানগণ বাবা আদমের হত্যাস্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বাবা আদম মসজিদের সামনের দেওয়ালের উপরের অংশে ফরাসী ভাষায় ( তুঘরা অক্ষরে ) একটি শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপি থেকে জানা যায় , ৮৮৮ হিজরীর রজব মাসে ১৪৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মালিক কাফুর পূণ্য অর্জনের জন্য বাবা আদম মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক মতে ১১৭৮ সালে বিক্রমপুরের বল্লাল রাজার সাথে যুদ্ধে বাবা আদম শহীদ হবার ৩০০ শত বছর পর এ মসজিদটি নির্মিত হয়।।
মসজিদটির নির্মাণ সম্পর্কীয় সকল তথ্য এই শিলালিপিটিতে রয়েছে। মসজিদটিতে কোন জানালা এবং বরান্দা নেই। কথিত আছে মসজিদের গাত্রে মূল্যবান মনিরত্ন সংযোজিত ছিল যাহা মগ দস্যুরা লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমপুরের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় কোন এক সময় ভুমিকম্পে মসজিদটির তিনটি গম্বুজ ছাদসহ ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে সংস্কারে তা আবার আগের রূপে নিয়ে যাওয়া হয়। এক সময় হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা বিভিন্ন আশা নিয়ে এই মসজিদে মানত করতে আসত।
বাবা আদম ( রহ.) সর্ম্পকে বিক্রমপুরে বহু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে । তবে জনশ্রুতিগুলোর সবই বাবা আদম ( রহ.) ও বল্লাল সেনের যুদ্ধ সর্ম্পর্কিত। ঐতিহাসিকভাবে সত্য বিক্রমপুরে যখন হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাজত্ব ছিল তখন বাবা আদম ( রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বিক্রমপুরে আসেন। বাবা আদম শহীদ ( রহ.) মসজিদটির নির্মাণ সম্পর্কে নানারূপ উপাখ্যান ও কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। দি রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল গ্রন্থে সেন রাজা বল্লাল সেনের মৃত্যু এবং বাবা আদম মসজিদ নির্মাণ বিভিন্ন জনশ্রুতির কথা উল্লেখ রয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, রামপালের অদূরবর্তী আবদুল্লাহপুর গ্রামের কানাইচং মাঠের জনৈক মুসলমান গোহত্যা করে রাজা বল্লাল সেনের নির্যাতনের ভয়ে বিক্রমপুর থেকে পালিয়ে মক্কায় গমন করেন। বল্লালী নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য বাবা আদমের শরনাপন্ন হন। বাবা আদম বল্লালী নির্যাতনের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে ৭ (সাত) হাজার সৈন্য নিয়ে বিক্রমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বঙ্গে এসে বল্লাল সেনের রাজধানী রামপালের উপকন্ঠে কাজী কসবা (বর্তমান দরগা বাড়ি) গ্রামে ঘাটি গাড়েন। এখানে একটি নিজের নামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন নামকরণ করেন বাবা আদম মসজিদ। অন্য আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে বাবা আদম মক্কা থেকে বঙ্গে এসে রামপালের কাজী কসবায় তাবু ফেলেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে রাজা বল্লাল সেন সংবাদ পেয়ে বাবা আদমকে হত্যার জন্য কাজী কসবায় গমন করেন। নামাজরত অবস্থায় বাবা আদমকে নিজ তরবারি দিয়ে হত্যা করতে না পেরে বাবা আদমের নির্দেশ মোতাবেক বল্লাল রাজা নিজ তরবারি ফেলে বাবা আদমের তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে। বাবা আদম যে জায়গায় নামাজরত ছিলেন ঠিক সে জায়গায় এক রাতের মধ্যে অলৌকিকভাবে একটি মসজিদ তৈরি হয়ে গেল। তখন থেকে মসজিদটির নাম হলো বাবা আদম মসজিদ। জনশ্রুতি যাই থাকুক বাবা আদম মসজিদকে কেন্দ্র করে বিক্রমপুরে ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে।
আর্ক. সার্ভে অব ইনডিয়া (১৯২৭-১৯২৮) থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একবার এর সংস্কার করেছিল। এর পর থেকে দীর্ঘ সময়ে আর কোন সংস্কার করা হয়নি। ১৯৯১ সালে শুধু মাত্র চারিপাশে লোহার দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৮ সালের পর থেকেই এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বাবা আদম মসজিদটি শুধু মুন্সীগঞ্জেরই নয়, সমগ্র উপমহাদেশের একটি দর্শনীয় স্থান। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে এ মসজিদ সম্বলিত একটি ডাক টিকেট প্রকাশ করে।
মসজিদের খতিব মো. সানাউল্লাহ বলেন, বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পরিয়েছি কোথাও এমন শান্তি পাইনি। মসজিদে কোন জানালা কপাট না থাকলেও গরমের সময় কোন গরম এবং শীতের সময় ঠান্ডা লাগে না। মনের প্রশান্তিতে এলাকার বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এখানে নামাজ পড়েন। একারণে মসজিদের ভেতরে স্থান সংকুলান হয় না। আবার মসজিদে কোন বারান্দা না থাকায় খোলা আকাশের নিচে নামাজের ব্যবস্থা করতে হয়।
মসজিদ কমিটির সভাপতি মিরকাদিম পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হোসেন রেনু বলেন, মসজিদটি কয়েক’শ বছরের মুসলিম ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ছাদে ফাটল দেখা দিয়েছে পানি পরে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকায় নিজেদের উদ্যোগে কোন কাজ করাও যায় না।
নিজস্ব প্রতিবেদক :
১৫ মার্চ, ২০২৫, 5:28 AM

বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি হলো মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম (রহ.) মসজিদ। মসজিদটি সুলতানি শাসন আমলের স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণশৈলীতে নির্মিত। মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। বঙ্গে সেন বংশের পতন আর বিক্রমপুরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রামপালের সীমান্তবর্তী বর্তমান মিরকাদিম পৌরসভার কাজী কসবা (বর্তমান দরগা বাড়ি) গ্রামে ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট কারুকার্য খচিত নয়ানাভিরাম ৫৪২ বছরের পুরানো বাবা আদম মসজিদটির অবস্থান। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর - পশ্চিমে চার কিলোমিটার দূরে বাবা আদম মসজিদটি রয়েছে। মসজিদটি ছয়টি সম আকৃতির এবং একই রকম উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজে আচ্ছাদিত। ছয়টি গম্বুজ দুই সারিতে স্থাপিত। মসজিদটির নির্মাণশৈলী চমৎকার।
জনশ্রুতি এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিক্রমপুরে বল্লাল সেনের রাজত্ব কালে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসা আধ্যাত্মিক সাধক শহীদ বাবা আদম ( রহ.) এর নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।
মসজিদটির নির্মাণশৈলির মধ্যে সুলতানি আমলের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও অলংকরণশৈলী রয়েছে। সুলতানী শাসনামলে নির্মিত মসজিদের ন্যায় বাবা আদমের মসজিদের কার্নিস ও ছাদ বক্রাকার। মসজিদটির নামকরণ নিয়ে কোন শিলালিপি নেই। তবে মসজিদের সামনের দেওয়ালে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান ফতে শাহের শাসনামলে সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মালিক কাফুর শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন পূণ্য অর্জনের জন্য।
১৪৭৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করে দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৪৮৩ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। শহীদ বাবা আদম (রহ.) এর শহীদ হবার ৩০০ বছরেরও বেশি সময় পরে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট বাবা আদম মসজিদটি আয়তাকার ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। উত্তর - দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট এবং পূর্ব - পশ্চিমে প্রস্থ ৩৬ ফুট। মসজিদের চার কোণায় চারটি অষ্ট কোণাকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারের ধাপে ধাপে পাতলা ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর দেওয়াল ইট নির্মিত যার প্রশস্ততা প্রায় সাড়ে ৬ ফুট। দেওয়াল নির্মাণে ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি মাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছে ।
পুরো মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে লাল পোড়া মাটি দিয়ে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে দু‘পাশে দুইটি গ্রানাইড পাথরের ধূসর বর্ণের স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভ দুইটি মেঝে থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকৃতি এবং এর পর ষোল কোণাকৃতির। স্তম্ভ দুইটি এবং চার দেওয়ালের উপরই ছয়টি গম্বুজ দাঁড়িয়ে আছে।স্তম্ভের সাহায্যে পুর্ব - পশ্চিমে দুই সারিতে এবং উত্তর - দক্ষিণে তিন সারিতে বিভক্ত। অভ্যন্তরভাগে পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। প্রধান মেহরাব এবং দুই পাশের মেহরাব ও পাশের দেওয়ালে পোড়া মটির লতা পাতা , গোলাপফুল , ঝুলন্ত তক্তীর নকশা রয়েছে। তিনটি মেহরাবের উপরে চমৎকার দুস্তরে ধূসর বর্ণের কারুকাজ করা রয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালের পশ্চাৎভাগ বাইরের দিকে তিন স্তরে বর্ধিত। পেছনের বর্ধিতাংশটি সুন্দর টেরাকোটা অলংকরণে নকশাকৃত। মসজিদের সম্মুখভাগে তিনটি খিলানাকৃতির প্রবেশ পথ রয়েছে, এর উপরিভাগ সুন্দরভাবে খাজকাটা । ঝুলন্ত শিকল এবং ঘন্টার অলংকরণ রয়েছে। বর্তমানে শুধু মাঝের প্রবেশপথটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সেন রাজত্বের শেষ যুগে বাংলায় মুসলিম শক্তি চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠার পর বিজয়ী মুসলমানগণ বাবা আদমের হত্যাস্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বাবা আদম মসজিদের সামনের দেওয়ালের উপরের অংশে ফরাসী ভাষায় ( তুঘরা অক্ষরে ) একটি শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপি থেকে জানা যায় , ৮৮৮ হিজরীর রজব মাসে ১৪৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মালিক কাফুর পূণ্য অর্জনের জন্য বাবা আদম মসজিদটি নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক মতে ১১৭৮ সালে বিক্রমপুরের বল্লাল রাজার সাথে যুদ্ধে বাবা আদম শহীদ হবার ৩০০ শত বছর পর এ মসজিদটি নির্মিত হয়।।
মসজিদটির নির্মাণ সম্পর্কীয় সকল তথ্য এই শিলালিপিটিতে রয়েছে। মসজিদটিতে কোন জানালা এবং বরান্দা নেই। কথিত আছে মসজিদের গাত্রে মূল্যবান মনিরত্ন সংযোজিত ছিল যাহা মগ দস্যুরা লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমপুরের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় কোন এক সময় ভুমিকম্পে মসজিদটির তিনটি গম্বুজ ছাদসহ ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে সংস্কারে তা আবার আগের রূপে নিয়ে যাওয়া হয়। এক সময় হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা বিভিন্ন আশা নিয়ে এই মসজিদে মানত করতে আসত।
বাবা আদম ( রহ.) সর্ম্পকে বিক্রমপুরে বহু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে । তবে জনশ্রুতিগুলোর সবই বাবা আদম ( রহ.) ও বল্লাল সেনের যুদ্ধ সর্ম্পর্কিত। ঐতিহাসিকভাবে সত্য বিক্রমপুরে যখন হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাজত্ব ছিল তখন বাবা আদম ( রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বিক্রমপুরে আসেন। বাবা আদম শহীদ ( রহ.) মসজিদটির নির্মাণ সম্পর্কে নানারূপ উপাখ্যান ও কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। দি রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল গ্রন্থে সেন রাজা বল্লাল সেনের মৃত্যু এবং বাবা আদম মসজিদ নির্মাণ বিভিন্ন জনশ্রুতির কথা উল্লেখ রয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, রামপালের অদূরবর্তী আবদুল্লাহপুর গ্রামের কানাইচং মাঠের জনৈক মুসলমান গোহত্যা করে রাজা বল্লাল সেনের নির্যাতনের ভয়ে বিক্রমপুর থেকে পালিয়ে মক্কায় গমন করেন। বল্লালী নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য বাবা আদমের শরনাপন্ন হন। বাবা আদম বল্লালী নির্যাতনের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে ৭ (সাত) হাজার সৈন্য নিয়ে বিক্রমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বঙ্গে এসে বল্লাল সেনের রাজধানী রামপালের উপকন্ঠে কাজী কসবা (বর্তমান দরগা বাড়ি) গ্রামে ঘাটি গাড়েন। এখানে একটি নিজের নামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন নামকরণ করেন বাবা আদম মসজিদ। অন্য আরেকটি জনশ্রুতি রয়েছে বাবা আদম মক্কা থেকে বঙ্গে এসে রামপালের কাজী কসবায় তাবু ফেলেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে রাজা বল্লাল সেন সংবাদ পেয়ে বাবা আদমকে হত্যার জন্য কাজী কসবায় গমন করেন। নামাজরত অবস্থায় বাবা আদমকে নিজ তরবারি দিয়ে হত্যা করতে না পেরে বাবা আদমের নির্দেশ মোতাবেক বল্লাল রাজা নিজ তরবারি ফেলে বাবা আদমের তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে। বাবা আদম যে জায়গায় নামাজরত ছিলেন ঠিক সে জায়গায় এক রাতের মধ্যে অলৌকিকভাবে একটি মসজিদ তৈরি হয়ে গেল। তখন থেকে মসজিদটির নাম হলো বাবা আদম মসজিদ। জনশ্রুতি যাই থাকুক বাবা আদম মসজিদকে কেন্দ্র করে বিক্রমপুরে ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে।
আর্ক. সার্ভে অব ইনডিয়া (১৯২৭-১৯২৮) থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ একবার এর সংস্কার করেছিল। এর পর থেকে দীর্ঘ সময়ে আর কোন সংস্কার করা হয়নি। ১৯৯১ সালে শুধু মাত্র চারিপাশে লোহার দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৮ সালের পর থেকেই এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বাবা আদম মসজিদটি শুধু মুন্সীগঞ্জেরই নয়, সমগ্র উপমহাদেশের একটি দর্শনীয় স্থান। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে এ মসজিদ সম্বলিত একটি ডাক টিকেট প্রকাশ করে।
মসজিদের খতিব মো. সানাউল্লাহ বলেন, বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পরিয়েছি কোথাও এমন শান্তি পাইনি। মসজিদে কোন জানালা কপাট না থাকলেও গরমের সময় কোন গরম এবং শীতের সময় ঠান্ডা লাগে না। মনের প্রশান্তিতে এলাকার বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এখানে নামাজ পড়েন। একারণে মসজিদের ভেতরে স্থান সংকুলান হয় না। আবার মসজিদে কোন বারান্দা না থাকায় খোলা আকাশের নিচে নামাজের ব্যবস্থা করতে হয়।
মসজিদ কমিটির সভাপতি মিরকাদিম পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হোসেন রেনু বলেন, মসজিদটি কয়েক’শ বছরের মুসলিম ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ছাদে ফাটল দেখা দিয়েছে পানি পরে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকায় নিজেদের উদ্যোগে কোন কাজ করাও যায় না।