আছে ডাকঘর-ডাকবাক্স-ডাকপিয়ন, নেই শুধু 'চিঠি'

রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, 3:16 PM

আছে ডাকঘর-ডাকবাক্স-ডাকপিয়ন, নেই শুধু 'চিঠি'
ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে হারিয়ে গেছে ডাকঘরের ব্যস্ততা ও ঐতিহ্যবাহী ‘ডাকবাক্স’। পরিত্যক্ত ডাকবাক্সগুলো এখন শুধুই করুন চোখে দাঁড়িয়ে আছে কালের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে।
যাযাবর কবি বিনয় মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়- ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। কবির কথাকে সত্য প্রমাণ করে দিন দিন বিজ্ঞান উৎকর্ষিত হচ্ছে আর পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে আবেগ। এখন আর আগের মতো ডাক অফিসে নেই লোকজনের আনাগোনা। ফলে ব্যক্তিগত চিঠির গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। ফলে ব্যস্ততা কমেছে ডাকঘরের আর সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকবাক্স। বর্তমানে চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস। আর অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্ পাঠানো হচ্ছে ইমেইল কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসে। ফলে বর্তমান ডিজিটাল যুগে ডাকঘর আর ডাক বাক্সের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। আজও অবহেলায় পরে আছে জরাজীর্ণ ডাকবাক্স, আছে ডাকপিয়ন, নেই শুধু 'চিঠি'।
সরেজমিনে জেল সদরসহ কয়েকটি এলাকার ডাকঘর ঘুরে দেখাগেছে, বেশিরভাগ এলাকার ডাকবাক্সের ঢালাইয়ের লোহার স্থানে স্থানে মরিচা ধরে ক্ষয়ে পড়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নব্বই দশক পর্যন্ত যার গায়ে প্রলেপ দেওয়া ছিল ধনীর বউয়ের লাল টকটকে রঙের শাড়ির মতো, প্রযুক্তির পদতলে পিষ্ট হয়ে এখন তা গরীবের ছেঁড়া শাড়ীর মতো বিবর্ণ ধূসর হয়ে গেছে।
জেলা সদরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ও সঙ্গীত শিল্পী কান্তি রঞ্জন রায় চৌধুরীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এক যুগ আগেও আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। ছেলে চিঠি লিখত মাকে, স্বামী স্ত্রীকে, প্রবাসী নিজের পরিবারকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজ আর কেউ চিঠি লিখে না। এখন আর কাউকে গভীর উৎকণ্ঠায় চিঠির অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না।
সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি বলেন, চিঠিকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে অনেক কালজয়ী গান। আমরা এখনো শুনি- ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে....’, 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’..... এমন আরও আবেগ মিশ্রিত গান। চিঠির আদলে রচিত হয়েছে রবিঠাকুরের গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধন হারা’ এর মতো পত্রোপন্যাস। কবি জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত চিঠিপত্রও সাহিত্যের অন্যতম লেখনী।
বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল এ্যন্ড কলেজ) বাংলা বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক বিজয় চন্দ্র দাস বলেন, চিঠি শুধুই একটি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, বরং এটি একটি শিল্প। সুন্দর হাতের লেখা, লেখনশৈলীতে পরিপূর্ণ একটি চিঠির গুরুত্ব হাজারটি ইলেকট্রনিক খুদে বার্তায় মিলবে না। নিজের হাতে চিঠি লেখায় লেখকের আবেগের তারতম্য অনুধাবন করা যেতো। খুশির সংবাদের চিঠি গুলো লেখার সময় কোনো কোনো শব্দ কলমের ডগা থেকে সাদা কাগজে বেরিয়ে আসার সময় উত্তেজনায় লেখকের আঙুল কেঁপে উঠত, দুঃসংবাদের চিঠি গুলোতে খুঁজলে হয়তো দুই আধ ফোঁটা চোখের জলের দাগও পাওয়া যেতো।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে চিঠির ভাষার সাথে ফিকে হয়ে যাচ্ছে চিঠিতে ব্যবহার করা সম্বোধনের শব্দগুলোর (শ্রীচরণেষু, প্রিয়তমেষু, সুচরিতেষু, প্রাণেশ্বর, প্রীতিভাজনেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু) ব্যবহার চোখে পড়ে না। প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পুরানো ঐতিহ্য হিসাবে আমরা শখ করে হলেও একটা চিঠি লিখে ডাকবাক্সে পাঠাতে পারি প্রিয়জনদের ঠিকানায়। তাতে সময়ের বিবর্তনে হারানো চিঠির যুগের স্বাদ কিছুটা হলেও আস্বাদন করা যেতে পারে।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদ বাবুল বলেন, বর্তমান যুগ আধুনিক যুগ, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণমাধ্যমকর্মীরা সহজেই সংবাদের কাজ করতে পারছেন। যেখানে যে অবস্থায় তারা অবস্থান করেন, সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে অল্প সময়ে সংবাদ লিখে নিজ অফিসে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এমন একসময় আমরা অতিবাহিত করেছি, তখন আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ছিল না। হাতে সংবাদ লিখে তা ডাকের মাধ্যমে অফিসে পাঠাতে হতো। তা আবার প্রকাশ হয়ে ডাকের মাধ্যমে আসতো। তবে এখন কম্পিউটার আর মোবাইল ব্যবহারে মানুষ নিজ হাতের লেখাটাও ভুলে যেতে বসেছে।
জেলা পোস্টমাস্টার জসীম উদ্দিন বলেন, আগের দিনের মত এখন আর চিঠি পত্র লেনদেন হয় না। বর্তমানে পোষ্ট অফিসে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনেক কাজ, পার্সেল, বীমা, পরীক্ষার খাতা, সঞ্চয়পত্রের মত কাজগুলো হচ্ছে।
রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি :
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, 3:16 PM

ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে হারিয়ে গেছে ডাকঘরের ব্যস্ততা ও ঐতিহ্যবাহী ‘ডাকবাক্স’। পরিত্যক্ত ডাকবাক্সগুলো এখন শুধুই করুন চোখে দাঁড়িয়ে আছে কালের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে।
যাযাবর কবি বিনয় মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়- ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। কবির কথাকে সত্য প্রমাণ করে দিন দিন বিজ্ঞান উৎকর্ষিত হচ্ছে আর পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে আবেগ। এখন আর আগের মতো ডাক অফিসে নেই লোকজনের আনাগোনা। ফলে ব্যক্তিগত চিঠির গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। ফলে ব্যস্ততা কমেছে ডাকঘরের আর সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকবাক্স। বর্তমানে চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস। আর অফিসিয়াল ডকুমেন্টস্ পাঠানো হচ্ছে ইমেইল কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসে। ফলে বর্তমান ডিজিটাল যুগে ডাকঘর আর ডাক বাক্সের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে শূন্যের কোঠায়। আজও অবহেলায় পরে আছে জরাজীর্ণ ডাকবাক্স, আছে ডাকপিয়ন, নেই শুধু 'চিঠি'।
সরেজমিনে জেল সদরসহ কয়েকটি এলাকার ডাকঘর ঘুরে দেখাগেছে, বেশিরভাগ এলাকার ডাকবাক্সের ঢালাইয়ের লোহার স্থানে স্থানে মরিচা ধরে ক্ষয়ে পড়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নব্বই দশক পর্যন্ত যার গায়ে প্রলেপ দেওয়া ছিল ধনীর বউয়ের লাল টকটকে রঙের শাড়ির মতো, প্রযুক্তির পদতলে পিষ্ট হয়ে এখন তা গরীবের ছেঁড়া শাড়ীর মতো বিবর্ণ ধূসর হয়ে গেছে।
জেলা সদরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ও সঙ্গীত শিল্পী কান্তি রঞ্জন রায় চৌধুরীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এক যুগ আগেও আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। ছেলে চিঠি লিখত মাকে, স্বামী স্ত্রীকে, প্রবাসী নিজের পরিবারকে, প্রেমিক প্রেমিকাকে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আজ আর কেউ চিঠি লিখে না। এখন আর কাউকে গভীর উৎকণ্ঠায় চিঠির অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না।
সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি বলেন, চিঠিকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে অনেক কালজয়ী গান। আমরা এখনো শুনি- ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে....’, 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’..... এমন আরও আবেগ মিশ্রিত গান। চিঠির আদলে রচিত হয়েছে রবিঠাকুরের গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধন হারা’ এর মতো পত্রোপন্যাস। কবি জীবনানন্দ দাশের অপ্রকাশিত চিঠিপত্রও সাহিত্যের অন্যতম লেখনী।
বাউসী অর্দ্ধচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল এ্যন্ড কলেজ) বাংলা বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক বিজয় চন্দ্র দাস বলেন, চিঠি শুধুই একটি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, বরং এটি একটি শিল্প। সুন্দর হাতের লেখা, লেখনশৈলীতে পরিপূর্ণ একটি চিঠির গুরুত্ব হাজারটি ইলেকট্রনিক খুদে বার্তায় মিলবে না। নিজের হাতে চিঠি লেখায় লেখকের আবেগের তারতম্য অনুধাবন করা যেতো। খুশির সংবাদের চিঠি গুলো লেখার সময় কোনো কোনো শব্দ কলমের ডগা থেকে সাদা কাগজে বেরিয়ে আসার সময় উত্তেজনায় লেখকের আঙুল কেঁপে উঠত, দুঃসংবাদের চিঠি গুলোতে খুঁজলে হয়তো দুই আধ ফোঁটা চোখের জলের দাগও পাওয়া যেতো।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে চিঠির ভাষার সাথে ফিকে হয়ে যাচ্ছে চিঠিতে ব্যবহার করা সম্বোধনের শব্দগুলোর (শ্রীচরণেষু, প্রিয়তমেষু, সুচরিতেষু, প্রাণেশ্বর, প্রীতিভাজনেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু) ব্যবহার চোখে পড়ে না। প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পুরানো ঐতিহ্য হিসাবে আমরা শখ করে হলেও একটা চিঠি লিখে ডাকবাক্সে পাঠাতে পারি প্রিয়জনদের ঠিকানায়। তাতে সময়ের বিবর্তনে হারানো চিঠির যুগের স্বাদ কিছুটা হলেও আস্বাদন করা যেতে পারে।
বারহাট্টা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক ফেরদৌস আহমেদ বাবুল বলেন, বর্তমান যুগ আধুনিক যুগ, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণমাধ্যমকর্মীরা সহজেই সংবাদের কাজ করতে পারছেন। যেখানে যে অবস্থায় তারা অবস্থান করেন, সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে অল্প সময়ে সংবাদ লিখে নিজ অফিসে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এমন একসময় আমরা অতিবাহিত করেছি, তখন আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ছিল না। হাতে সংবাদ লিখে তা ডাকের মাধ্যমে অফিসে পাঠাতে হতো। তা আবার প্রকাশ হয়ে ডাকের মাধ্যমে আসতো। তবে এখন কম্পিউটার আর মোবাইল ব্যবহারে মানুষ নিজ হাতের লেখাটাও ভুলে যেতে বসেছে।
জেলা পোস্টমাস্টার জসীম উদ্দিন বলেন, আগের দিনের মত এখন আর চিঠি পত্র লেনদেন হয় না। বর্তমানে পোষ্ট অফিসে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনেক কাজ, পার্সেল, বীমা, পরীক্ষার খাতা, সঞ্চয়পত্রের মত কাজগুলো হচ্ছে।