ড. ইউনূসের ৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি: বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্বসংযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
২৭ মে, ২০২৫, 2:27 PM

ড. ইউনূসের ৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি: বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্বসংযোগ
চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর কুটনৈতিক সুনামকে কাজে লাগিয়ে এ দেশের মসৃণ এ পরিবর্তনের গতিশীলতাকে সামলে যাচ্ছেন নিপুণভাবে। তিনি তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখী কূটনীতি দিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে উন্মোচন করেছেন এক নতুন দিগন্ত ।
বিশ্লেষকরা একে বলছেন ‘৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি’, যেখানে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সবদিকেই ছড়িয়েছে তাঁর কুটনৈতিক উদ্যোগ।
আগের ভারতকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতির ধারা থেকে সরে এসে ইউনূস প্রশাসন আস্থা ও নিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলছে নতুন এক কুটনৈতিক বাস্তবতা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের পর নতুন কোনো প্রশাসনের জন্য বৈদেশিক নীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে চ্যালেঞ্জিং। কারণ, তাঁর সময়কালের কুটনৈতিক কাঠামো ছিল প্রবলভাবে ভারত নির্ভর।
কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস সেই আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে তাঁর বৈশ্বিক খ্যাতি ও কুটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মসৃণ পরিবর্তনশীলতাকে সামলিয়ে পররাষ্ট্রনীতিকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলেছেন।
গত ২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ড. ইউনূস দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছেন। এর লক্ষ্য ছিল, দেশের অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীল রূপান্তর এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুন করে দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করানো।
বৃহত্তর এই কুটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে কাল বুধবার সকালে চারদিনের জাপান সফরে যাচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি টোকিওতে অনুষ্ঠেয় ৩০তম নিক্কেই ফোরামে অংশ নেবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
অধ্যাপক ইউনূসের চীন সফরে যাওয়ার আগেই জাপান সফরসূচি ঠিক করা হয়েছিল। এমনটি করা হয়েছে, যাতে বোঝানো যায়, বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব বেড়ে গেলেও তাঁর সরকার সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে কূটনীতি করতে চায়।
দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং কৌশলগতভাবে পুনর্বিন্যস্ত বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, ড. ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতি সুস্পষ্ট বার্তা দেয় যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গঠনমূলক এবং স্বাধীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়।
বাইডেন থেকে শি জিনপিং, শি থেকে মোদি, আঞ্চলিক রাজধানী থেকে আন্তর্জাতিক ফোরাম সব দিকেই ইউনূসের কূটনীতির হাত প্রসারিত হয়েছে। ‘৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি’ বলতে বোঝানো হয় একটি পূর্ণাঙ্গ, সামগ্রিক ও সুষম পররাষ্ট্রনীতি, যেখানে প্রতিটি দিক বিবেচনায় রাখা হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বহুমুখী কূটনীতি বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসকে নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যগত মিত্রদের পাশাপাশি নতুন জোটও গড়ে তোলা হচ্ছে। যার লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক রূপান্তরের সময়ে জাতীয় স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
প্রথম বড় কুটনৈতিক সাফল্য: সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের ক্ষমা
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য আসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিককে সাজার আদেশ দিয়েছিল দেশটির আদালত। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সরাসরি আলোচনার পর তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই ঘটনাকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, ‘এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।’ তৌহিদ হোসেন এই সাফল্যের কৃতিত্ব দেন অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও কৌশলী কূটনীতিকে। তাঁর মতে, এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে এই বিক্ষোভ ছিল বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং কোনো বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে নয়।
পশ্চিমা বিশ্বে দৃঢ় বার্তা:
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক কূটনীতিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটান ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।
সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে আলোচনা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো জোরদার, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে।
বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের মিত্র সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে উভয়েই সামাজিক ব্যবসা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর একদিনেই ১৬টি উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
সেদিন তিনি পাকিস্তান, কানাডা ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী, ব্রাজিল ও মরিশাসের প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভল্কার তুর্কের সঙ্গে বৈঠক করেন।
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। তিনি জানান, নতুন বাংলাদেশ সকল নাগরিকের জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠান যা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতি অন্যতম প্রধান একটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সমর্থন নিশ্চিত করে।
ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল জানায়, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রতি তাদের অব্যাহত সমর্থন বজায় রাখবে। দলটি ঢাকার সাথে ব্রেক্সিট-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরো গভীর করতে লন্ডনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের সূচনা: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অক্টোবরের শুরুতে প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা সফর করেন। এটি বহির্বিশ্বে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থনের বার্তা দেয়।
গত বছর ৪ অক্টোবর ৫৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসেন আনোয়ার ইব্রাহিম। দলটিতে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প, পররাষ্ট্র, পরিবহণ এবং ধর্মবিষয়ক উপমন্ত্রীসহ সংসদ সদস্যরাও ছিলেন। এ সফর ছিল মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ইউনূস সরকারের প্রতি শক্ত কুটনৈতিক সমর্থনের প্রতিফলন।
চার দশকের বেশি সময় ধরে অধ্যাপক ইউনূসের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত আনোয়ার ইব্রাহিম। এবারের সফরেও গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি ইউনূসের অবিচল অঙ্গীকারের প্রশংসা করেন তিনি। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশকে আরো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অধিকারভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনূসের সক্ষমতার ওপর তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে (ড. ইউনূস) চিনি। আমি জানি, আপনি নারী-পুরুষের জীবন, মানবাধিকার ও মর্যাদার জন্য কতটা নিবেদিত। আপনার অবস্থানকে পুরোপুরি সমর্থন জানাই।’
এর দুই মাস পর, তিমুর লেস্তের প্রেসিডেন্ট রামোস-হোর্তা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও এই সফরের তাৎপর্য ছিল গভীর। এটি মিয়ানমারে চলমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৌশলগত জোট গঠনের দিকে ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
এই সফরগুলোর কুটনৈতিক গুরুত্ব নিহিত আঞ্চলিক কৌশলগত হিসেব-নিকেশে। মিয়ানমারের ওপর আসিয়ানের বর্তমান চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে এবং রোহিঙ্গা সংকটে নেপিডো’র ওপর চাপ সৃষ্টিতে এ সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
একই সঙ্গে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ লাভের পথে থাকা টিমর-লেস্টে ভবিষ্যতে জোটটির অভ্যন্তরীণ গতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ হিসেবে উঠে আসতে পারে।
নিজস্ব প্রতিবেদক :
২৭ মে, ২০২৫, 2:27 PM

চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর কুটনৈতিক সুনামকে কাজে লাগিয়ে এ দেশের মসৃণ এ পরিবর্তনের গতিশীলতাকে সামলে যাচ্ছেন নিপুণভাবে। তিনি তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখী কূটনীতি দিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে উন্মোচন করেছেন এক নতুন দিগন্ত ।
বিশ্লেষকরা একে বলছেন ‘৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি’, যেখানে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সবদিকেই ছড়িয়েছে তাঁর কুটনৈতিক উদ্যোগ।
আগের ভারতকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতির ধারা থেকে সরে এসে ইউনূস প্রশাসন আস্থা ও নিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে গড়ে তুলছে নতুন এক কুটনৈতিক বাস্তবতা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের পর নতুন কোনো প্রশাসনের জন্য বৈদেশিক নীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে চ্যালেঞ্জিং। কারণ, তাঁর সময়কালের কুটনৈতিক কাঠামো ছিল প্রবলভাবে ভারত নির্ভর।
কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস সেই আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে তাঁর বৈশ্বিক খ্যাতি ও কুটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মসৃণ পরিবর্তনশীলতাকে সামলিয়ে পররাষ্ট্রনীতিকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলেছেন।
গত ২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ড. ইউনূস দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের কুটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছেন। এর লক্ষ্য ছিল, দেশের অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীল রূপান্তর এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অঙ্গনে নতুন করে দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করানো।
বৃহত্তর এই কুটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে কাল বুধবার সকালে চারদিনের জাপান সফরে যাচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি টোকিওতে অনুষ্ঠেয় ৩০তম নিক্কেই ফোরামে অংশ নেবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
অধ্যাপক ইউনূসের চীন সফরে যাওয়ার আগেই জাপান সফরসূচি ঠিক করা হয়েছিল। এমনটি করা হয়েছে, যাতে বোঝানো যায়, বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব বেড়ে গেলেও তাঁর সরকার সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে কূটনীতি করতে চায়।
দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং কৌশলগতভাবে পুনর্বিন্যস্ত বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়, ড. ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতি সুস্পষ্ট বার্তা দেয় যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গঠনমূলক এবং স্বাধীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়।
বাইডেন থেকে শি জিনপিং, শি থেকে মোদি, আঞ্চলিক রাজধানী থেকে আন্তর্জাতিক ফোরাম সব দিকেই ইউনূসের কূটনীতির হাত প্রসারিত হয়েছে। ‘৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি’ বলতে বোঝানো হয় একটি পূর্ণাঙ্গ, সামগ্রিক ও সুষম পররাষ্ট্রনীতি, যেখানে প্রতিটি দিক বিবেচনায় রাখা হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বহুমুখী কূটনীতি বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসকে নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যগত মিত্রদের পাশাপাশি নতুন জোটও গড়ে তোলা হচ্ছে। যার লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক রূপান্তরের সময়ে জাতীয় স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
প্রথম বড় কুটনৈতিক সাফল্য: সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের ক্ষমা
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য আসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিককে সাজার আদেশ দিয়েছিল দেশটির আদালত। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সরাসরি আলোচনার পর তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই ঘটনাকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, ‘এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।’ তৌহিদ হোসেন এই সাফল্যের কৃতিত্ব দেন অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও কৌশলী কূটনীতিকে। তাঁর মতে, এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে এই বিক্ষোভ ছিল বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং কোনো বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে নয়।
পশ্চিমা বিশ্বে দৃঢ় বার্তা:
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক কূটনীতিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটান ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।
সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে আলোচনা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো জোরদার, গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে।
বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের মিত্র সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে উভয়েই সামাজিক ব্যবসা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর একদিনেই ১৬টি উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
সেদিন তিনি পাকিস্তান, কানাডা ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী, ব্রাজিল ও মরিশাসের প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভল্কার তুর্কের সঙ্গে বৈঠক করেন।
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। তিনি জানান, নতুন বাংলাদেশ সকল নাগরিকের জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠান যা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতি অন্যতম প্রধান একটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সমর্থন নিশ্চিত করে।
ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল জানায়, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রতি তাদের অব্যাহত সমর্থন বজায় রাখবে। দলটি ঢাকার সাথে ব্রেক্সিট-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরো গভীর করতে লন্ডনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের সূচনা: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অক্টোবরের শুরুতে প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা সফর করেন। এটি বহির্বিশ্বে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থনের বার্তা দেয়।
গত বছর ৪ অক্টোবর ৫৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসেন আনোয়ার ইব্রাহিম। দলটিতে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্প, পররাষ্ট্র, পরিবহণ এবং ধর্মবিষয়ক উপমন্ত্রীসহ সংসদ সদস্যরাও ছিলেন। এ সফর ছিল মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ইউনূস সরকারের প্রতি শক্ত কুটনৈতিক সমর্থনের প্রতিফলন।
চার দশকের বেশি সময় ধরে অধ্যাপক ইউনূসের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত আনোয়ার ইব্রাহিম। এবারের সফরেও গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি ইউনূসের অবিচল অঙ্গীকারের প্রশংসা করেন তিনি। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশকে আরো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অধিকারভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনূসের সক্ষমতার ওপর তাঁর পূর্ণ আস্থা আছে।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে (ড. ইউনূস) চিনি। আমি জানি, আপনি নারী-পুরুষের জীবন, মানবাধিকার ও মর্যাদার জন্য কতটা নিবেদিত। আপনার অবস্থানকে পুরোপুরি সমর্থন জানাই।’
এর দুই মাস পর, তিমুর লেস্তের প্রেসিডেন্ট রামোস-হোর্তা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেন এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও এই সফরের তাৎপর্য ছিল গভীর। এটি মিয়ানমারে চলমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৌশলগত জোট গঠনের দিকে ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
এই সফরগুলোর কুটনৈতিক গুরুত্ব নিহিত আঞ্চলিক কৌশলগত হিসেব-নিকেশে। মিয়ানমারের ওপর আসিয়ানের বর্তমান চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে এবং রোহিঙ্গা সংকটে নেপিডো’র ওপর চাপ সৃষ্টিতে এ সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
একই সঙ্গে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ লাভের পথে থাকা টিমর-লেস্টে ভবিষ্যতে জোটটির অভ্যন্তরীণ গতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ হিসেবে উঠে আসতে পারে।